ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

টিকে থাকার নির্মম লড়াইয়ে ঈদ আসে না তাদের

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২৩
টিকে থাকার নির্মম লড়াইয়ে ঈদ আসে না তাদের

ঢাকা: ঈদে কর্মজীবীদের বড় একটি অংশ যখন নাড়ির টানে বাড়ি গেছে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে, তখন রাজধানীতে শ্রমজীবী মানুষের একটি অংশ রয়ে গেছে জীবনে টিকে থাকার কঠিন বাস্তবতায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার নির্মম লড়াইয়ে।

তাদের জীবনে ঈদ আসে না।

আনন্দ-উৎসবের রঙ ফিকে হয়ে গেছে। এদের কেউ নিরাপত্তাকর্মী, কেউ হকার, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ মৌসুমি ফল ও শরবত ফেরি করে বেড়ান, কেউ রিকশাচালক, কেউ ভ্যানচালক, কেউবা ভাঙেন ইট। এমনই কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদকের।

সদরঘাট মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজিদের কাছে সাহায্য চাইছেন আমেনা বেগম। তিনি বাংলানিউজকে জানান, পাঁচ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে এক মেয়ে নিয়ে ঢাকাতে আসেন। ঢাকায় আসার এক বছর পড় দুর্ঘটনায় স্বামীর পা ভেঙে যায়। এরপর থেকে সংসারের হাল ধরেন তিনি। এখন বিভিন্ন স্থানে ইট ভাঙার কাজ করেন।

তিনি বলেন, রোজা আসার পর থেকে কাজ কমে গেছে। আজ ঈদের দিন ছুটি। কিন্তু কাজ না করলে খামু কী। কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে বাজার করি। স্বামী অচল। ঈদের মধ্যে মেয়েটারে নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারিনি। এখন মানুষের কাছে হাত পাতছি যদি মেয়েটাকে ভালো-মন্দ কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারি।  

তিনি আরও বলেন, দেহেন আমার ভাগ্য। আজ আমারে হাত পাততে হইতাছে। ঈদের জামাত শেষে নামাজিরা দয়া কইরা যা দেবে, তা দিয়া আজকে একটু ভালো খাবার কিনমু। আসলে দু-চারদিন ধরে কাজ বন্ধ তো। টাকাও জমাইতে পারি নাই। আমাগো জীবনে ঈদ আহে না ভাই। আমরা গরিব, আমাদের আবার ঈদ কীসের!

এসব কথা বলতে বলতেই চোখের জল গড়াতে শুরু করে। হাত দিয়ে চোখ মুছতে থাকেন আমেনা বেগম।

পুরান ঢাকার সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন একটি ভ্যানের ওপর বসে গল্প করছেন। ঈদের শুভেচ্ছা জানালে তারাও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। কী করেন, জিজ্ঞেস করতেই তারা সবাই ভ্যান চালান বলে জানান।  

তারা জানান, ঈদের ছুটি। তাই সবকিছু বন্ধ। আজ কোনো কাজ নেই। ঈদের নামাজ পড়ে এখানে এসে গল্প করছেন। সবাই একই মেসে থাকেন।  

তাদের মধ্য থেকে মো. তোতা মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের আবার ঈদ ভাই! গরিবের ঈদ নাই। গত ৩৫ বছর ধরে এখানে ভ্যান চালাই। যা আয় করি বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। কোনো ঈদে বাড়ি যাই, নইলে ঢাকাতেই ঈদ করি। আমরা সবাই যেহেতু এক মেসে থাকি তাই নিজেদের মধ্যে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই। গল্প-আড্ডা- গানের পর নিজেরাই পছন্দের খাবার রান্না করে খাই। এভাবেই আমাদের ঈদ কাটে।

সদরঘাট শাখার সিটি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মো. আসিফ বাংলানিউজকে বলেন, ঈদে ছুটি মেলেনি। সবাই বাড়ি যাচ্ছে দেখে মন খারাপ লাগছে। অফিস ছুটি দেয় নাই। কী আর করব? বেতন-বোনাস যা পাইছি, বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।  

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মো. নাঈম বাংলানিউজকে বলেন, এক মাসও হয় নাই যোগ দিয়েছি, তাই বেতন পাইনি। ঈদে কেনাকাটা করতে পারিনি। বেতন হলেই টাকা বাড়িতে পাঠাব। চাকরি যাতে হাতছাড়া না হয়, সেজন্য ঈদের সময় রোজার মধ্যে যোগ দিয়েছি। ২৪ ঘণ্টা ডিউটি। তাই বুথ খালি রেখে কোথাও যেতে পারি না। এজন্য ঈদে নামাজও পড়া হয়নি।  

ভোলার মো. আব্দুর রহমান ফেরি করে শরবত বিক্রি করেন গুলিস্তানে। ঈদের নামাজ পরে শরবতের ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, গেল বার ঈদুল আজহায় বাড়ি যেতে পারলেও এবার আর বাড়ি যেতে পারেননি।  

তিনি বলেন, চার ছেলেমেয়ের দুজনকে নতুন পোশাক কিনে দিতে পেরেছি। আর দুজনকে দিতে পারিনি। এজন্য বাড়ি যাইনি। ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে কল দিয়ে যাচ্ছে। কোন মুখে কল রিসিভ করব। এজন্য সন্তানেরা রাগ করেছে। পরে স্ত্রীকে বলেছি ঈদের পর বাড়িতে এলে তাদের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে যাব। এজন্য ঈদের দিনও ভ্যান নিয়ে বের হয়েছি।

 

মুন্সিগঞ্জের মো. ওমর ফারুক গুলিস্তান বায়তুল মোকাররম এলাকার টুপি ও পাঞ্জাবি বিক্রি করেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের দিন একটু বেচাকেনা ভালো হয়। তাই চিন্তা করলাম কাছেই যেহেতু বাড়ি, ঈদের দিন বিকেলে বাড়ি যামু। বাড়িতে বউ আর তিন ছেলে আছে। নাতিপুতিও আছে। তাদের সবার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। শুধু আমার জন্যই কেনা হয় নাই। সবাইকে দিতে গিয়ে টাকা শেষ হয়ে গেছে। আজ যা বেচাকেনা করুম, তা দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় নাতিপুতিদের জন্য খেলনা কিনে নিমু।  

সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির সামনে কথা হয় চাঁদপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। ঢাকায় গত ১০ বছর ধরে আইসক্রিম বিক্রি করেন। তিনি জানান, প্রতি বছর ঈদে গেলেও এ বছর যেতে পারেননি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের এত দাম বেড়েছে, সংসারের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাতে টাকা-পয়সা খুব একটা নাই। যা আয় করি, সবই গ্রামে পাঠিয়ে দিই। গত এক বছরে অনেক টাকা ধার করেছি। ঈদে বাড়ি গেলে বাড়তি খরচ হয়। সেজন্য ঈদে বাড়িতে যাই নাই।

রাজধানীতে গত ১০ বছর ধরে রিকশা চালান মো. আনোয়ার। তিনি বলেন, ঈদের দিন ঢাকা ফাঁকা থাকে। রিকশাও কম থাকে। ভাড়া বেশি পাওয়া যায়। এজন্য ঈদের কয়েক দিন পড়ে বাড়ি যাই। গ্রামে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। তা দিয়ে বাজার সদাই ও জামা কাপড় কিনে নেবে। আমারও ইচ্ছা করে সবাইরে নিয়ে ঈদ করতে। কিন্তু বাড়িতে গেলে খরচ বাড়বে। দুইটা পোলা মাইয়া লেখাপড়া করে। স্কুল খুললেই পরীক্ষা শুরু হবে। সেজন্য মাস্টার রেখেছি। তাদের বেতন, স্কুলের বেতন, সংসার খরচ অনেক টাকা লাগে ভাই। রিকশা চালিয়ে আর কতো টাকা পাই।  এজন্য অনেক হিসাব করে চলতে হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২৩
জিসিজি/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।