ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বৃদ্ধাশ্রমে যাদের ঈদ কাটছে চোখের জলে

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২৩
বৃদ্ধাশ্রমে যাদের ঈদ কাটছে চোখের জলে

সাভার (ঢাকা): পরিবারের সবাই যখন ঈদ আনন্দে মশগুল। তখন দূর নির্জন গ্রামে প্রিয়জন ছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে নিভৃতে চোখের জল ফেলছেন একদল মানুষ।

অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। তবুও যেন বৃদ্ধাশ্রমই কর্মক্ষম এ মানুষগুলোর কাছে শ্রেয়। আর সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে অসহায় এ মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনাকারীরাও।

ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের নির্জন শৈলান গ্রামের এ বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত মানুষগুলো কারও বাবা, কারও মা। একসময় সন্তানের সব আশা পূরণ করা ব্যক্তিটি আজ বয়সের ভারে কর্মক্ষম হওয়ায় কদর হারিয়েছেন পরিবারে। সন্তান কিংবা ছেলের স্ত্রীর কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাইতো শেষ বয়সে একটু নিশ্চিত মৃত্যুর আশায় তারা আশ্রয় নিয়েছেন নির্জন এ বৃদ্ধাশ্রমে।

বছর ঘুরে ঈদ এলে প্রিয় সন্তানের স্মৃতি মনে হলেই সিক্ত হয় তাদের নয়ন। তারপরও বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে সন্তাদের ভুলতে চেষ্টা করে প্রত্যেকেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন নিজেদের মতো করেই।

ঈদুল ফিতরের আগের দিন শুক্রবার (২১ এপ্রিল) ধামরাইয় উপজেলার সোমভাগ ইউনিয়নের শৈলান গ্রামে শৈলান প্রবীণ নিবাসে গিয়ে কথা হয় নিজ পরিবার থেকে আসা কয়েকজন বৃদ্ধা মা ও বাবার সঙ্গে।

দুই ছেলে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই নিজ হাতে মানুষ করেছেন বাবা মো. আলী আনোয়ার। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তিনি যখন কর্মক্ষম হয়ে পড়েছেন, হারিয়েছেন প্রিয় সঙ্গিনী স্ত্রীকে। তখন ছেলের কাছে নিজেকে বোঝা ভেবে চলে এসেছেন শৈলান গ্রামের এ বৃদ্ধাশ্রমে। এখানকার বিনামূল্যে পাওয়া সেবা আর ওষুধ তাকে মানুষিক প্রশান্তিও দিয়েছে। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে ভুলে যেতে চেষ্টা করছেন তার সন্তানদের।

ষাট ঊর্ধ্ব আলী আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, যশোরে আমার ২০ বছরেরও বেশি সময় ওএমএস এর ডিলারশিপ ছিল। আমার স্ত্রীর নামে লাইসেন্সটি করা ছিল। স্ত্রী ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর বছর খানেক আগে লাইসেন্সটি বাতিল হয়ে যায়। আমি হয়ে গেলাম বেকার। এখন আমার দুই ছেলে রয়েছে। তাদের সংসারে আমি বোঝা। তাদের কথা আর কি বলবো। আমার টাকা নেই স্ত্রী নেই আমিও তাদের কাছে নেই।

পরিবার ছাড়া ঈদ করতে আপনার কষ্ট হবে না? এমন প্রশ্নের পর আলী আনোয়ারের চশমার নিচ দিয়ে ছল ছল করে পানি পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলেন, না বাবা, আমি এখানেই ভালো আছি। ঈদটা আমার এখনেই ভালো কাটবে। আমি এর আগে কখনো পরিবার ছাড়া ঈদ করিনি। এখন মানিয়ে নিতে হবে।

আলী আনোয়ারের মতো আরও অনেকের ঠাঁই হয়েছে এ বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তান কিংবা প্রিয়জনদের উপেক্ষায় জর্জরিত সর্বস্ব হারানো এ মানুষগুলো জীবনের শেষ ভরসা পেয়েছেন এখানেই। তারা এখানে থাকতে চান জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।

বৃদ্ধা জাহানারা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। মেয়েটি মারা যাওয়ার পর আমি এখানে চলে আসি। ছেলে আমাকে তার কাছে রাখতে চায় কিন্ত তার স্ত্রী আমাকে দেখতে পারে না। তাই আমি এখানে চলে এসেছি। সবাইকে ছাড়া এবার ঈদ করবো। মনে সেই কষ্ট আছে। কিন্তু তাদের আচার ব্যবহারের কথা মনে হলে মনে হয় এখানেই ভালো আছি।

অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ দিন হাসপাতালে পড়ে ছিলেন মজিবর রহমান। এক মাস হলো শৈলান প্রবীণ নিবাসে ঠায় হয়েছে তার। তার ছেলে মেয়েরা থাকলেও তাকে নিতে কেউ আসেনি। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি হাসপাতালে পরে ছিলাম, এখানকার স্যাররা আমাকে নিয়ে এসেছেন। তারা চিকিৎসা দিয়েছেন, এখন খাবার দেয়, ওষুধ দেয়। আমি খুব ভালো আছি। ছেলে-মেয়ের কথা মনে করি নাই। ঈদও তাদের সঙ্গে করতে চাই না।  

বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক ওয়াহিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অসহায় পরিবারহারা এ মানুষগুলোর সেবা করতে পেরে বেশ আনন্দ পাই আমি। আমি তাদের ভেতর আমার বাবা-মাকে খুঁজে পাই। আমার বাসা উত্তরাতে কিন্তু আমি সব সময় এখানেই পরে থাকি। তাদের সেবা যত্ন করি। এখানে সকাল সন্ধ্যা সবার জন্য আমি কাজ করি। আমার একটুও খারাপ লাগে না। সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকি। এই যে ঈদ আসছে সবাই আমরা একটা পরিবারের মতো। সবাই এক সঙ্গে ঈদ করবো।

বৃদ্ধাশ্রমটি পরিচালনাকারী ট্রাস্টি আব্দুল মতিন জানালেন, এখানে বসবাসরতদের জন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন তারা। বিনামূল্যে খাবার, ওষুধসহ পোশাকও দেওয়া হয়। ঈদেও নতুন কাপড় দেওয়া ছাড়াও তাদের জন্য রান্না করা হয় ভালো খাবার।

তিনি বলেন, যেসব মানুষের বয়স হয়ে গেছে, পরিবার তাদের দেখভাল করতে পারে না। এছাড়া সন্তান রয়েছে কিন্তু তাদের খেয়াল নেওয়া, যত্ন নেওয়া, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, খাবার ও কথা বলার অবকাশ তারা দিতে পারে না। আসলে তাদের জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব বাবা-মার কথা চিন্তুা করে এ শৈলান প্রবীণ নিবাস বানানো হয়েছে। আমরা এখানে যে অবকাঠামোটি করেছি এখানে আমরা ৮০ জনকে রাখতে পারবো। এখনো আমাদের সমাজে এ মেসেজটি যায়নি, যে প্রবীণ নিবাসেও প্রবীণরা ভালো থাকতে পারে।

২০২২ সালে ধামরাই উপজেলার সোমভাগ ইউনিয়নের শৈলান গ্রামে দিলরুবা কবির-আব্দুল মতিন ট্রাস্টের অধীন ৮০ জনের বসবাসের পরিসর নিয়ে এ বৃদ্ধাশ্রমটি যাত্রা শুরু করে। বৃদ্ধাশ্রমটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সাতজন। তারা হলেন- সভাপতি দিলরুবা কবির, ট্রাস্টি আব্দুল মতিন, ট্রাস্টি মাহাবুব হোসেন সাহেদ, ড. মোহাম্মদ ফয়জুল কবির খান, রাহাত চৌধুরী, মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও ইউনাইটেড ট্রাস্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের ২০ জন বৃদ্ধ বসবাস করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২৩
এসএফ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।