লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের পোদ্দার বাজারে যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান এবং ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেওয়ান ফয়সাল (৩৮)।
হত্যার পরিকল্পনাকারী, শ্যুটার এবং কিলিং মিশনে থাকা হত্যাকারীদের নাম প্রকাশ করেছেন তিনি।
পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচন এবং উপজেলা যুবলীগের কমিটি নিয়ে যুবলীগ নেতা নোমানের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে দেওয়ান ফয়সাল হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন বলে স্বীকার করেছেন।
মঙ্গলবার (২ মে) বিকেলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন দেওয়ান ফয়সাল।
আদালত সূত্র জানায়, এদিন বিকেল সোয়া ৫টার দিকে দেওয়ান ফয়সালকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি অঞ্চল চন্দ্রগঞ্জ আদালতের বিচারক আনোয়ারুল কবীরের আদালতে তোলা হয়। রাত প্রায় ৮ টার দিকে তাকে আদালত থেকে বের করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিন রাতে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের এ তথ্য জানিয়েছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি হত্যাকারীদের নাম প্রকাশ করেননি।
দেওয়ান ফয়সাল রামগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব কাজিরখিল গ্রামের এটিএম ছালেহের ছেলে। তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দেওয়ান বাচ্চুর ছোট ভাই। নোমান-রাকিব হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত তৃতীয় আসামি ফয়সাল। ঘটনার পর একটি সিসি টিভি ফুটেজে দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, সোমবার (১ মে) ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে ফয়সালকে আটক করে র্যাব। মঙ্গলবার (২ মে) সকালে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এসময় তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালতের বিচারকের সামনে তিনি নিজের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
পুলিশ সুপার বলেন, হত্যার ঘটনায় আমরা এ পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ছয়জন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি সিসি টিভি ফুটেজ পাওয়া যায়। সেখানে আটজন লোককে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন আলমগীর, অন্যজন দেওয়ান ফয়সাল। দেওয়ান ফয়সালকে হত্যা মামলার তদন্ত সহায়তাকারী সংস্থা র্যাব সোমবার ঠাকুরগাঁও থেকে আটক করেছে। আজ সকালে তাকে আমাদের কাছে দেয় র্যাব। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা ঘটনার অনেক বিষয় জানতে পেরেছি। ঘটনার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা তিনি স্বীকার করেছেন। অনেকের নামও বলেছেন। তদন্তের স্বার্থে আপাতত তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
এসপি বলেন, দেওয়ান ফয়সালকে আদালতে সোপর্দ করলে তিনি নিজেই জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে তার কাছে মোবাইল ফোনে কল আসে- নোমানকে মারতে হবে। নোমানের সঙ্গে তার দুটি বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল। রামগঞ্জ পৌর কাউন্সিলর নির্বাচনে নোমান তার প্রতিপক্ষকে সাহায্য করেছিলেন এবং উপজেলা যুবলীগের কমিটি গঠন নিয়ে তার সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এজন্য যুবলীগ নেতা নোমানের প্রতি তার রাগ ক্ষোভ ছিল।
পুলিশকে দেওয়ান ফয়সাল বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নোমান এলাকায় একজনকে মারধর করেন। তার প্রতিশোধ হিসেবে নোমানকে তারা মারধর করার পরিকল্পনা করেন। ফোন কল পেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে নাগেরহাট এলাকায় যান তিনি। সেখানে মোটরসাইকেল রেখে হেঁটে ঘটনাস্থল করাতকলের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন ফয়সালসহ অন্যরা। এর মধ্যে রাকিব ওই পথ দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয় নোমানকে নিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে লক্ষ্য করে শর্টগান দিয়ে গুলি করেন হত্যাকারীরা। এতে রাকিব পড়ে যান। নোমান লাফ দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে একটি দোকানে ঢুকলে সেখানে তার ওপর হামলা চালানো হয়। এরপর আরেকটি দোকানে ঢুকলে সেখান থেকে বের করে এনে তিনজনের (হত্যাকারী) মধ্যে একজন নোমানের মাথায় গুলি করেন। এরপর হত্যাকারীরা হেঁটে গিয়ে অটোরিকশায় ওঠেন। দেওয়ান ফয়সাল ওই এলাকার একটি কাঁচা রাস্তা হয়ে রামগঞ্জ এলাকায় চলে যান। পরে তিনি এক ব্যক্তির বাসায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং ওই ব্যক্তিকে ঘটনাস্থল থেকে তার মোটরসাইকেলটি নিয়ে আসতে বলেন। দেওয়ান ফয়সালের বক্তব্য অনুযায়ী ঘটনার পর দিন তিনি তার রামগঞ্জের বাসায় ছিলেন। পরে ঢাকা যান। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও পালিয়ে যান তিনি।
হত্যা মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, জিজ্ঞাসবাদে ফয়সাল অনেকের নাম বলেছেন। তার থেকে পাওয়া তথ্যে আমরা আটজনকে শনাক্ত করেছি। এটা গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।
লক্ষ্মীপুরের বশিকপুরের পোদ্দার বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা নোমানের বড় ভাই বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বাদী হয়ে চন্দ্রগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বশিকপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং একটি অস্ত্রধারী বাহিনীর প্রধান আবুল কাশেম জেহাদীকে প্রধান আসামি করে আরও ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ১৪-১৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত প্রধান আসামি আবুল কাশেম জেহাদীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০১২১ ঘণ্টা, মে ০২, ২০২৩
এসআই