ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

চালের দাম কমলেও পাইকারি-খুচরা পর্যায়ে বিস্তর ফারাক

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩২ ঘণ্টা, মে ৪, ২০২৩
চালের দাম কমলেও পাইকারি-খুচরা পর্যায়ে বিস্তর ফারাক

ঢাকা: বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় ঈদুল ফিতরের পর গত এক সপ্তাহে মোটা ও চিকন সব ধরনের চালের দাম কমেছে। এতে দীর্ঘদিন পর চালের বাজারেও অস্থিরতা কমেছে।

তবে পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা কমলেও খুচরা বাজারে কমেছে মাত্র ২ থেকে ৩ টাকা। বেঁচে থাকার জন্য জরুরি এ খাদ্যপণ্যের দাম কমায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ক্রেতারা স্বস্তি বোধ করছেন। একই সঙ্গে বাজার স্থিতিশীল রাখতে মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারিতে বাড়াতে গুরুত্বারোপ করেছেন।

এদিকে নতুন চাল বাজারে এলে কয়েক দিনের মধ্যে দাম আরও কমে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, এ সময়ে চালের দাম কমা স্বাভাবিক। প্রতি বছর বিশেষ করে এপ্রিল, মে মাসে নতুন ধান ঘরে ওঠে। এছাড়া হাওর অঞ্চল থেকে কয়েকটি মোকামে নতুন ধান আসা, পুরনো চালের কেনাবেচা না থাকা, ব্যবসায়ী, পাইকার ও ফড়িয়াদের কাছে প্রচুর ধান-চালের মজুদ থাকে। কয়েকদিন পর থেকে বাজারে নতুন চাল আসতে শুরু করবে। ফলে দাম কম থাকবে।

বৃহস্পতিবার (৪ মে) রাজধানীর কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মান ভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭৪ টাকা। নাজিরশাইল চাল ৭০ থেকে ৭৮ টাকা, মাঝারি মানের বিআর আটাশ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা ও হাইব্রিড মোটা ৪৮ টাকা।

এক সপ্তাহ আগেও খুচরা বাজারে জাত ও মান ভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৭০ থেকে ৭৬  টাকা, নাজিরশাইল চাল ৭২ থেকে ৮০ টাকা, মাঝারি মানের বিআর আটাশ চাল ৬০ থেকে ৬২ টাকা, মোটা চাল স্বর্ণা ৫৫ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল।

পাইকারি বাজারে বর্তমানে চিকন চাল প্রতি কেজি মিনিকেট মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা ৩০০০ থেকে ৩২০০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে মান ভেদে বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৪ টাকা আর বস্তা ৩৫০০ থেকে ৩৭০০ টাকা। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭১ টাকা আর ৫০ কেজির বস্তা ৩০০০ থেকে ৩৫৫০ টাকা  যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭৭ টাকা, বস্তা ৩২৫০ থেকে ৩৮৫০ টাকা। দেশি বাসমতী চাল প্রতিকেজি ৭০ টাকা, বস্তা  ৩৫০০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ছিল ৭৬ টাকা, আর বস্তা ৩৮০০ টাকা।

মাঝারি মানের প্রতি কেজি বিআর ২৮ চাল ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা আর বস্তা ২৭৫০ থেকে ২৮৫০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, বস্তা ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকা। লতা প্রতিকেজি ৫৭ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, আর বস্তা ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকা।

মোটা চাল প্রতি কেজি স্বর্ণা/পাইজাম চাল মান ভেদে ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা আর বস্তা ২৩৫০ থেকে ২৪০০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা আর বস্তা ২৫০০ থেকে ২৬০০ টাকা। হাইব্রিড ধানে চাল (গুটি) বা সব চেয়ে মোটা চালের দাম কেজিতে ৪৩ টাকা, আর বস্তা ২১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৪৬ টাকা কেজি, বস্তা ২৩০০ টাকায় বিক্রি হতো।

বাবুবাজার চালের আড়তে চাল কিনতে আসেন বেসরকারি কর্মকর্তা সৌরভ কুমার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে জীবনযাপন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। একটি পণ্য কিনলে আরেকটি কেনার বাজেট থাকছে না। এজন্য পাইকারি বাজার থেকে একটু কম দাম দিয়ে কিনতে এসেছি। আজকে বাজারে দেখি চালের দাম কেজিতে পাইকারিতে ৫ থেকে ৬ টাকা কমেছে। চালের দাম কমায় স্বস্তি পাচ্ছি। তারপরও পাইকারি বাজারের সাথে খুচরা বাজারে বিস্তার ফারাক থাকে। সরকারকে এসব বিষয়গুলো মনিটরিং করতে হবে।

সূত্রাপুর বাজার থেকে ২৫ কেজির এক বস্তা চাল কিনেছেন কামরুল হাসান। প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সংসার চালানো অনেক কষ্ট। চালের দাম কমেছে শুনে ভালো লাগলো। তবে এই দাম কতদিন স্থায়ী হয় সেটা দেখার বিষয়। এখন চালের মৌসুম তাই দাম কম। এতে লোকসান হচ্ছে কৃষকদের। মিলমালিকরা এখন ধান কিনে মজুদ করে রাখবে। এক দুই মাস পর যখন কৃষকের মজুদ শেষ হবে তখন বেশি দামে বাজারে চাল ছাড়বে। এখানে সরকারের নজরদারি করতে হবে যাতে কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত মজুদ না করতে পারে। তাহলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে।

এ বিষয়ে পুরান ঢাকার বাবুবাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স রশিদ রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আবদুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর ধানের বাম্পার ফল হয়েছে।   এছাড়া বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। ফলে চালের দাম পাইকারিতে মান ভেদে ৫ থেকে ৬ টাকা কমেছে। সামনে কয়েকদিন পর নতুন চাল বাজারে আসবে তখন দাম আরও কমবে।

তিনি বলেন, ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকরা খুশি। সরকার এ বছর ধানের দাম বাড়িয়েছে। সাধারণ কৃষক বেশি দামে ধান বিক্রি করছে। যদিও তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এখন চাল আমদানি করলে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এছাড়া বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বেশি চাল কিনে নিচ্ছে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং বাড়াতে হবে।

বাবুবাজারের মেসার্স জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির ম্যানেজার মো. রুবেল বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের পর এক সপ্তাহ ধরে সব ধরনের চালের দাম ৫ থেকে ৬ টাকা কেজিতে কমেছে। আর বস্তায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। ভরা মৌসুম তাই দাম কমেছে। একই সঙ্গে বাজারে চাহিদাও কম। কারণ এখন সবার ঘরেই ধান চাল রয়েছে।

বাবুবাজারের পাইকারি আড়তদার দয়াল ভাণ্ডারের ম্যানেজার সাঈদ আহমেদ বলেন, এখন ধানের মৌসুম তাই সব ধরনের চালের দাম কমেছে। মান ভেদে প্রতিবস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

রায়সাহেব বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা মো. রাজু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, চালের দাম গত ৮ থেকে ১০ দিন ধরে চালের দাম কমতির দিকে। কিন্তু আমরা এখন লোকসান দিয়ে চাল বিক্রি করছি। রমজান মাসে যে দাম চাল কিনেছি। এখন তার থেকে কমে গেছে। আমরা কেজিতে মান ভেদে ২ থেকে ৩ টাকা কমে চাল বিক্রি করছি।

সূত্রাপুর বাজারের চাল বিক্রেতা মো. আনিস ও আবুবক্কর বাংলানিউজকে জানান, সরকার ধান ও চালের দাম বাড়িয়েছে। এখন বোরোর মৌসুম। কয়েকদিন পর নতুন চাল বাজারে আসবে। ঈদের পর থেকে চাহিদাও একটু কমেছে। এজন্য দাম কমতির দিকে। পাইকারি বাজারে দাম কমলেও আমরা সে রকম দাম কমাতে পারিনি। কারণ আমাদের বেশি দিয়ে কেনা। এখনও আগের দামেই বিক্রি করছি।

এ বিষয়ে বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বোরো ধানের মৌসুম এখন। গ্রামে সবার ঘরে ঘরে নতুন ধান। বাজারে নতুন চাল আসতে শুরু করেছে। ফলে চালের দাম কমতির দিকে। সামনে আরও কমবে। তবে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারে নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন। কেউ যাতে কারসাজি করে অতিরিক্ত মজুদ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এখন চালের ব্যবসা করে কোনো লাভ নেই। এজন্য ৩০০ চালের ঘর থেকে এখন মাত্র ১১৫ টা ঘর রয়েছে। কুষ্টিয়ার মিলগেট থেকে এক ট্রাকে ২৬০ বস্তা চাল আনতে খরচ পড়ে ১৭ হাজার টাকা। আর এরসাথে লেবার খরচসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতি বস্তায় খরচ হয় ৭৫ টাকা। এখন আমরা ৩৪০০ টাকায় চালের বস্তা কিনে এর সাথে ৭৫ টাকা যোগ করে আমাদের বিক্রি করতে হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। তাহলে বস্তায় লাভ হচ্ছে ২৫ টাকা। আর কেজিতে হচ্ছে ৫০ পয়সা। এভাবে তো আর ব্যবসা চলে না।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ২০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন হবে। চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ লাখ ৭৬ হেক্টর জমি। আর আবাদ হয়েছে প্রায় প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঠে ধানের অবস্থা ভালো, হাওরের ধানও ভালোভাবে কাটা গেছে। আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১০ লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন হতে পারে। কৃষকেরা ভালো দাম পাচ্ছেন। ধান কাটার পরই জমি থেকে ৯০০ থেকে ১১০০-১২০০ টাকা মণ দরে কৃষকেরা ধান বিক্রি করতে পারছেন।

মেশিনে কাটায় হাওরের ধান দ্রুত কাটা সম্ভব হয়েছে। এই মুহূর্তে হাওরের সাতটি জেলায় ৩৮০০ কম্বাইন হারভেস্টার ও ৬৭০টি রিপার দিয়ে ধান কাটা চলছে। পাকা ধান দ্রুত কাটার জন্য আমরা ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে হাওরে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে যাচ্ছি। শ্রমিকের মজুরি এখন বেশি ও শ্রমিক সংকট রয়েছে। মেশিনে ধান কাটায় দ্রুততার সঙ্গে ধান কাটা যাচ্ছে। একইসঙ্গে ধান কাটায় খরচ কম হচ্ছে। সবদিক বিবেচনায় কৃষকেরা এর সুফল পাচ্ছে।

আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, অনেকেই কৃষির উন্নয়নকে উন্নয়ন মনে করেন না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই মনে করেন উন্নয়ন মানে শুধু রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন, স্কুল-কলেজের বিল্ডিং বানানো। বিগত ১৪ বছরে কৃষিতে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে আমরা হাওরের কৃষককে ধান কাটার যন্ত্র দিচ্ছি; অর্থাৎ একটা যন্ত্রের দাম ২৮ লাখ টাকা হলে ২০ লাখ টাকা সরকার আর কৃষক মাত্র ৮ লাখ টাকা দিচ্ছে। এটি একটি বিরাট উন্নয়ন।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাওরভুক্ত সাত জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। মোট বোরো আবাদ হয়েছে (হাওর ও হাওরের বাইরে উঁচু জমি মিলে) ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। এখন পর্যন্ত হাওরে ৯০ ভাগ বোরো ধান কর্তনের মধ্যে সিলেটে ৯১ ভাগ, মৌলভীবাজারে ৯৭ ভাগ, হবিগঞ্জে ৮০ ভাগ, সুনামগঞ্জে ৯৬ ভাগ, কিশোরগঞ্জে ৮০ ভাগ, নেত্রকোনায় ৯৬ ভাগ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯২ ভাগ ধান কাটা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, মে ৪, ২০২৩
জিসিজি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।