ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সকালে রুটি বেচে সংসার চালান বৃদ্ধ মিন্নত, বাকি সময় কাটে ইবাদতে

মুহাম্মদ মাসুদ আলম. ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৪ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২৩
সকালে রুটি বেচে সংসার চালান বৃদ্ধ মিন্নত, বাকি সময় কাটে ইবাদতে চাঁদপুর হরিণাঘাটে সকালে মাটি চুলা নিয়ে বসেন মিন্নত আলী। রুটি বানিয়ে বেচেন তিনি।

চাঁদপুর: বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই, আটাত্তর হবে। বয়সের ভারে বেঁকে যাচ্ছে মেরুদণ্ড।

 তবুও সপ্তাহের সাতদিনই নিয়ম করে কাজে নেমে পড়েন মিন্নত আলী বেপারী। তার আয় দিয়েই চলে সংসার।

সংসার অবশ্য বড় নয়; স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই তার। নিঃসন্তান এ দম্পতি।  

রোজ সকালে মিন্নত চলে যান ফেরিঘাটে। সেখানে কয়েক ঘণ্টার জন্য বসেন রুটি বানাতে। এসব রুটি বেচেই চলে স্বামী-স্ত্রীর সংসার। গত ২০ বছর ধরে এভাবেই চলছে মিন্নত আলীর জীবন।

অবশ্য এ বৃদ্ধের অবস্থা এমন ছিল না। ফেরিঘাটেই ছিল তার বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ছিল বাড়ি-জমি। কিন্তু মেঘনার একাধিক ভাঙনের শিকার হয়ে তিনি নিঃস্ব হয়েছেন অনেক আগেই। তবে তাতে কোনো খেদ নেই মিন্নতের। সবকিছু হারিয়ে গেলেও কোনো অভিযোগ নেই তার।  

চাঁদপুর সদর উপজেলার ইব্রাহীমপুরের বাসিন্দা মিন্নত আলী। মেঘনায় তার ঘর-বাড়ি তলিয়ে যাওয়ার পর তিনি এখন বসত গড়েছেন পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন হানারচর ইউনিয়নের গোবিন্দিয়া গ্রামে।  

সেখানে চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুটের হরিণা ফেরিঘাটের এক কোণায় বসে রুটি বানিয়ে বিক্রি করেন মিন্নত আলী। ওই ঘাটেই পুরোনো ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে তার সেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

হরিণা ফেরিঘাটে দূর-দূরান্তের লোকজনের আনাগোনা রয়েছে। ইলিশের পাইকারী আড়ত রয়েছে সেখানে। চাঁদপুরের তাজা রূপালী ইলিশের স্বাদ নিতে অনেকেই ছুটে আসেন এই ফেরিঘাটে। তাদের কেউ কেউ স্বাদ নেন মিন্নত আলীর বানানো রুটির।

মিন্নত আলীর রুটি ও গুড়

সম্প্রতি ফেরিঘাটে গিয়ে দেখা গেল, আর সব দিনের মতো সেদিনও আড়তের পাশেই বসে রুটি বিক্রি করছেন বৃদ্ধ মিন্নত আলী। এই বয়সে কেন তিনি আয় রোজগারে মগ্ন, কেনই বা রুটি বেচেন এমন সব প্রশ্নের জবাবে দিতে গিয়ে মিন্নত আলী বর্ণনা করেন তার জীবনের ঘটনার কিছু অংশ।

মিন্নত আলী বলেন, আমার কোনো সন্তান নেই যে তার আয়ে চলব। স্ত্রী আর আমি একটি ঘরে থাকি। এই আমাদের সংসার। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বয়স্ক ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু সেটা মাত্র ৫০০ টাকা।  এ দিয়ে কি সংসার চলে? তাই পেটের চাহিদায় এই ঘাটে রুটি বিক্রি করি। গত ২০ বছর ধরেই আমি এখানে রুটি বেচে চলছি।  

কেমন বিক্রি হয় প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন রুটি ও গুড় বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকা। এক রুটি ও দুই টুকরো গুড় দাম ১০টাকা। যা লাভ হয়, তা দিয়ে সংসার চলে। ময়দা প্রতি কেজি ৭৫ টাকা এবং গুড় ক্রয় করি প্রতি কেজি ১৫০ টাকা। আসলে আমার যারা ক্রেতা, তারা অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দা। ঘাটে বাইরের লোকজন এখন কম আসে। কারণ ফেরিতে যানবাহন কম পার হয়। তেল ছাড়া ঘরের তৈরি রুটির স্বাদ নিতে অনেকেই আসেন। লাকড়ির চুলায় তৈরি হয় রুটি। অনেকেই এটা খেতে পছন্দ করেন।  

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিনে এই সামান্য আয় দিয়ে কি সংসার চলে? তিনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। বেশি সময় বসে থাকতে পারি না। ফজরের নামাজ আদায় করে ভোরে আসি এখানে। সকাল ৯টার মধ্যে বাড়িতে চলে যাই। বাকি সময়টা ইবাদত করে কাটাই।

তা কেমন চলছে জীবন? জবাবে আলহামদুলিল্লাহ বললেও ক্ষোভটা আটকে রাখতে পারলেন না। তার এই ক্ষোভ অবশ্য বর্তমান সমাজের পরিবর্তন নিয়ে। পরস্পরের মধ্যে মমত্ববোধের অভাব নিয়েই যতো ক্ষোভ তার।
 
মিন্নত আলী বলেন, আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু সমাজের পরিবর্তন দেখে মন ভালো থাকে না। মানুষের মধ্যে সম্পর্ক যেন কেমন হয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা কোনো কারণে অর্থ সংকটে পড়লে কেউ সহযোগিতা করতে চায় না। বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসে না। সহযোগিতা না করুক, কোনো ধরনের সহমর্মিতাও দেখায় না। কিন্তু ছোট বেলায় আমাদের সমাজ এমন ছিল না। এমন পরিস্থিতি দেখিনি তখন। এই সমাজকে সুন্দর করতে হলে আমাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ও মমত্ববোধ বাড়াতে হবে।

মিন্নত আলীর সামনে বসে রুটি ও গুড় খাচ্ছিলেন প্রবীণ মৎস্য ব্যবসায়ী মো. সিরাজুল ইসলাম ছৈয়াল। তিনিও এই ঘাটে ব্যবসা করেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে।  

তিনি বলেন, মিন্নত আলী এই ঘাটের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। মেঘনার ভাঙনে সব হারিয়েছেন। কিন্তু তিনি কারো কাছে হাত পাতেন না। রুটি বিক্রি করেই চলে তার সংসার। বয়স্ক পাতা পান ৫০০ টাকা। সেখান থেকেও জনপ্রতিনিধিরা ৩০ টাকা কেটে নেয়। আমাদের সমাজে শুধুমাত্র স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।