ঢাকা, বুধবার, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

উপকূলে রেডিও স্টেশন স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে কমিটি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৮ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
উপকূলে রেডিও স্টেশন স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে কমিটি ফাইল ফটো

ঢাকা: উপকূলীয় এলাকায় কয়েকটি রেডিও স্টেশন ও লাইটহাউজ স্থাপন সংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালকের (পিডি) বিরুদ্ধে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) অনুমোদন ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বিল পরিশোধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। লাইট হাউজ বা বাতিঘর প্রকল্প হিসেবে জনশ্রুত ‘এস্টাবিলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগেটেড নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি পিডি ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে এমন তথ্য প্রমাণ পেয়েছে।

এছাড়া উপ-প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ও সহকারি প্রকল্প পরিচালক (এপিডি) এবং নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) বিরুদ্ধেও আনা কিছু অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার বণিকের নেতৃত্বে ২৬ এপ্রিল পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সম্প্রতি নৌসচিবের কাছে আটটি সুপারিশসহ ৪২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। তবে মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছে। বহুল আলোচিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর। এটি বাস্তবায়নের সর্বশেষ বর্ধিত সময়সীমা আগামী বছরের জুন মাস।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডিজির অনুমোদন না নিয়ে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ ছাড়াও পিডির বিরুদ্ধে আইসিটি ইকুইপমেন্ট মোবিলাইজেশনের কাজ শেষ করার আগেই এ খাতের টাকা ব্যয় করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের দুবলার চর ও ভোলার চর কুকরি-মুকরিতে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজের বিল পাসের তৎপরতার কথাও উল্লেখ করেছে কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে ডিপিডিসহ এপিডিদের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ।

এছাড়া পিডির বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘকালক্ষেপণ হচ্ছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে অচলাবস্থার জন্য পিডি, ডিজি ও ঠিকাদার-তিন পক্ষকেই দায়ী করেছে কমিটি। তারা হলেন- পিডি ও অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান, মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক এবং কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ। তদন্তে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সহ-ঠিকাদার নিয়োগ, বেআইনিভাবে দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ ও ভীতি প্রদর্শনসহ সাতটি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, তাকে মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।  

এদিকে, এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা না হলেও কমডোর নিজামুল হককে এরই মধ্যে মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করে নৌ বাহিনীতে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার। তার স্থলে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, নৌ বাহিনীতে কর্মরত কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমকে। রোববার (২১ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত স্বপদেই রয়েছেন কমডোর নিজাম।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পিডি আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের বিরুদ্ধে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয়ের ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কয়েকটি অভিযোগ যাচাইয়ে ‘কারিগরি কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছে কমিটি। মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামহি কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। সূত্র মতে, এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে-পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ না দেওয়া, সংস্থাপ্রধান, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব, যথাসময়ে কাজ না করা ইত্যাদি।

এছাড়া কয়েকটি কাজের বিল যথাযথ প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছে কি না এবং কাজের গুণগত মান ঠিক আছে কি না- তা খতিয়ে দেখতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়, ওই কমিটি এসব ঘটনায় প্রকল্পের কোন কোন কর্মকর্তা দায়ী তা নির্ধারণ করবে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে নৌ মন্ত্রণালয় কমডোর নিজামকে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিল। এরপর তাকে প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ী অন্যদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে পিডি, ডিপিডি, এপিডি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো সুপারিশ করা হয়নি। কারিগরি কমিটি গঠন করে এই কমিটির মাধ্যমে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্তকালে বিভিন্নজনের মৌখিক (অনানুষ্ঠানিক) জবানিতে ডিপিডি ও এপিডিদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কাজ না করে বিল পরিশোধের নামে প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া কমডোর এ জেড এম জালালউদ্দিন নৌ অধিদপ্তরের ডিজি থাকাকালে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে আরো বিষ্ময়কর তথ্য উঠে আসে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কোন কাজে কে কতো টাকা ঘুষ দিয়েছেন, তার বর্ণনা রয়েছে। ঘুষবাবদ টাকা লেনদেনের এ ভয়ংকর বক্তব্য ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতেও স্থান পেয়েছে। তবুও প্রকল্পের এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে তাঁরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে কমডোর নিজামুল হক বলেন, বহুল আলোচিত ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি যথাসময়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য আলাদা দুটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। একটি হলো- প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন  এবং অপরটি হচ্ছে- পিডিকে সরিয়ে দিয়ে এ পদে নতুন কাউকে নিয়োগ। এর স্বপক্ষে সুনির্দিষ্ট অনেক কারণও উল্লেখ করেছিলাম। তবে নৌ মন্ত্রণালয় আমার প্রস্তাব না মেনে নিজেরা একটি কমিটি গঠন করেছিল; যেখানে অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কোনো প্রতিনিধি নেই। এছাড়া পিডিকেও স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
টিএ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।