ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দেখা থেকে লেখা

বাসে বাসে মারামারি, জীবন যাবে তাড়াতাড়ি

মো. জুবাইর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২৩
বাসে বাসে মারামারি, জীবন যাবে তাড়াতাড়ি

ঢাকা: আবু সালেহ মোহাম্মদ নাঈম একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। কাজ করেন রাজধানীর প্রগতি সরণির একটি প্রতিষ্ঠানে।

প্রতিদিন দুপুর ২টার দিকে তার ডিউটি। যাতায়াত করেন নিজের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা মোটরসাইকেলে। শনিবার (২৭ মে) দুপুরেও তার অফিস ডিউটি ছিল। কিন্তু বেলা থেকে ঘন মেঘ ও পরে বৃষ্টি হওয়ায় আজ তার যানটি বাসায় রেখে এসেছেন।

মিরপুর আনসার ক্যাম্প থেকে তিনি ওঠেন অছিম পরিবহনের (রেজি: নম্বর ১১৮২৮০) একটি বাসে, দুপুর ১টায়। ভেবেছিলেন দুপুরে রাস্তায় যানজট কম হবে। বাসও ছুটবে তার নিজস্ব গতিতে। কিন্তু তা হয়নি।

রাজধানীর বাসগুলো যে মানুষের পায়ের চেয়ে ধীর গতিতে চলে, গত সাত বছরে ভুলে গিয়েছিলেন নাঈম। এও ভুলে গিয়েছিলেন, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে থেমে যাত্রীদের জোর করে বাসে তোলা হয়, সে কথা। আজ দুপুর ১টা থেকে দুপুর ২টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত চলা পথে তিনি কী কী দেখলেন, তা-ই তুলে ধরা হলো এ লেখায়।

আনসার ক্যাম্প থেকে ওঠার পর অছিম পরিবহনের বাসটি মিরপুর-১ নম্বর পর্যন্ত আসতে থামে তিনবার। এ সময়টিতে অবশ্য বাসে তেমন যাত্রী ওঠেনি। মিরপুর-১ নম্বরে জনা দশেক যাত্রী তোলেন কন্টাক্টর হাসান। তারপরও সেখানে অন্তত ৫ মিনিট থেমে ছিল বাসটি। এরপর সেটি যাত্রা করে মিরপুর-২ নম্বরের সনি সিনেমা হল বরাবর। সেখানে অন্তত ৩ মিনিট থেমে থাকার পর মাত্র দুজন যাত্রী তোলেন হাসান। ২ নম্বর থেকে মিরপুর-১০ নম্বরের যাত্রা বাস থামে পাঁচবার। সনি পার হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বাস থামিয়ে নেওয়া হয় হার্ট ফাউন্ডেশন পর্যন্ত দুজন যাত্রী। মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে থামিয়ে নেওয়া হয় আরও চারজন, তারা যাবেন মিরপুর-১০ নম্বরে। এরপর আবার হার্ট ফাউন্ডেশনের সামনে, তারপর স্টেডিয়াম ও স্টেডিয়ামের শেষ প্রান্তে; তারপর অছিম পরিবহনের বাসটি থামে মিরপুর-১০ নম্বরের ফায়ার সার্ভিসের সামনে। সেখানে অন্তত ১০ মিনিট সময় কাটিয়ে মাত্র পাঁচজন যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাসটি।

সেখান থেকে ছেড়ে ফায়ার সার্ভিস ভবন পার না হতেই আবার থামে বাসটি। এভাবে থেমে থেমে এগিয়ে চলছিল মিরপুর-১২ নম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে বহু যাত্রী তোলা হয়। কিন্তু অছিম পরিবহনের চালকের দাবি, তারা সিটিং সার্ভিস দেন।

মিরপুর-১০ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত যাত্রায় বাসটি পাল্লা দেয় পাঁচ পাঁচটি বাসকে। এর মধ্যে নিজেদের কোম্পানির বাস ছিল তিনটি। যে তিনটিকে আবার অছিমের ১১৮২৮০ বাসটি ধাক্কা দেয় অন্তত সাতবার। ১২ নম্বর থেকে সিরামিক মোড় পর্যন্ত বসুমতী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে পাল্লা দেয় অছিমের বাসটি। একে অপরকে ধাক্কা দেয় তিন বার। কালশি মোড় আসার পর দুই বাস চালকের মধ্যে গালাগাল হয় ব্যাপক।

বাসের যাত্রীরা বিরক্ত হচ্ছিলেন এ সময়। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছিলেন না। পাছে আবার বাসে বাসে মারামারি, তর্ক-বিতর্কের কারণে নিজের জান না চলে যায়। কালশিতে অন্তত ৭ মিনিট অপেক্ষার পর অছিমের ১১৮২৮০ নম্বর বাস ছাড়ে। বৃষ্টিস্নাত দুপুরে বেশ জোরে-শোরে চলতে শুরু করে চার চাকার যানটি। বিপত্তি বাঁধে ইসিবি এসে। যাত্রী ওঠে তো ওঠে না, কন্টাক্টর হাসান গলা ফাটিয়ে যায়....

বিরক্ত হতে হতে নাঈম পরে চালকের কাছে যান। যাত্রী ও নিজের সময়ের ব্যাপারে তাকে বোঝান। কিন্তু বাংলাদেশে বাস চালকের ওপর কথা বলে এমন ‘হনু’ কে আছে? চালক আছেন নিজম্ব তবিয়তে। মিনিট দশেক পর তিনি বাস স্টার্ট দিলেন। লক্ষ্য ইসিবি চত্বর থেকে কুড়িল। এরমধ্যে ক্যান্টনমেন্টের ওপর দিয়ে যাওয়া ফ্লাইওভারে বসুমতীর একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে অছিমের এ বাসের। তা ছাড়া ছোট ছোট যান পেলে ড্রাইভারের বাউলি, চিন্তা ধরিয়ে দিচ্ছিল যাত্রীদের।

এ ফ্লাইওভার থেকে নেমে বাসটি থামে কুর্মিটোলা হাসপাতালের পাদদেশে। অন্তত ৩০ জন যাত্রী ওঠে ১১৮২৮০ নম্বর বাসে। তাও ড্রাইভার সাহেবের মন ভরে না। তিনি আরও যাত্রী নেবেন। নিলেনও। এরপর সাই করে বাস চলে আসে কুড়িল ফ্লাই ওভারে। সেটি পার হওয়ার পর কয়েকজন যাত্রীকে জোর করে নামান কন্টাক্টর হাসান। অথচ তারা যেতে চেয়েছিলেন যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের স্টপেজ পর্যন্ত।

এই ছিল চাকরিজীবী নাঈমের যাত্রা। মোটরসাইকেল রেখে বাসে চড়ে অফিসে আসার যাত্রা কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজধানীর এত সুন্দর ও সহজ রাস্তা দিয়ে আমার অফিসে আসতে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩৫ মিনিট (মোটরসাইকেলে)। কিন্তু ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লেগে যাবে সেটি ভাবিনি। বাস- তো, সময় লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ড্রাইভারদের অসুস্থ মানসিকতা, অজ্ঞতার কারণে মানুষের প্রাণ যেতে সময় লাগবে না।

রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা, আবার নামানো, সঠিক নিয়মে বাস না চালানো, নির্দিষ্ট স্টপেজে না দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা- বিষয়গুলো রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা দেখে না। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের রাজধানীতে এমনটা শোভা পায় না। এ অবস্থা চলছে বহুদিন ধরে। নিরসনে কাউকে ব্যবস্থা নিতে দেখি না।

তিনি আরও বলেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে বাসে বাসে মারামারিতে মানুষের জীবন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। অতীতেও হয়েছে। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বহু আন্দোলন হয়েছে। সরকার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু দিন শেষে কয়টি পালন হয়েছে? প্রতিটা মানুষ চায় স্বাভাবিক জীবন যাত্রা। কিন্তু তা হচ্ছে না। সড়কে যানজট থাকবে, কিন্তু সেটি সহনীয় পর্যায়ে হওয়া উচিত। বাসগুলোকে নির্দিষ্ট লেনে নির্দিষ্ট যায়গায় থামা উচিত। কিন্তু কোনো চালক কি সেটি মানে? দুর্ঘটনা হয়েছে, হচ্ছে। সামনে আরও হবে। মানুষ মরেছে, মরছে। সামনে আরও মরবে। সড়কে শৃঙ্খলা যতদিন পর্যন্ত না ফিরবে মানুষের বাড়ি বাড়ি কান্নার রোল আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।