ঢাকা, বুধবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সাংবাদিক নাদিম হত্যা

‘অজানা কারণে’ অধরা চেয়ারম্যানপুত্র ফাহিম, ওসি বললেন ‘আধুনিক ছেলে তো’  

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৮ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২৩
‘অজানা কারণে’ অধরা চেয়ারম্যানপুত্র ফাহিম, ওসি বললেন ‘আধুনিক ছেলে তো’   চেয়ারম্যান বাবুর সঙ্গে পুত্র ফাহিম

জামালপুর থেকে ফিরে: ‘যাদের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে সবাইকে চিহ্নিত করেছি। তবে সিসিটিভি ফুটেজে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু বা তার ছেলে ফাহিমকে দেখা যায়নি।

আর এখনও মামলাও হয়নি।  সেজন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে অভিযান চলছে। ’ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের জামালপুর ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৬ জুন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ঠিক এসব কথাই বলেছিলেন বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানা।

এ ঘটনায় সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে বকশীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।  

এই মামলায় এ পর্যন্ত ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে নয়জনকে। আর র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন। তবে ‘অজানা কারণে’ এখনো অধরা এই মামলার দুই নম্বর আসামি ফাহিম ফয়সাল রিফাত।

র‍্যাবের একটি সূত্র বলছে, চেয়ারম্যানপুত্র ফাহিমকে শনাক্ত করতে চেষ্টা চলছে।

ফাহিম ফয়সাল রিফাত বকশীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সদ্য বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর ছেলে।  

১৪ জুন রাতে হামলার সময় এই ফাহিমই সাংবাদিক নাদিমের মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করেন। পরদিন বিকেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাংবাদিক নাদিম।

হামলার সেই সিসিটিভি ফুটেজে চেয়ারম্যান বাবু কিংবা ফাহিমকে দেখা যায়নি। কারণ সাংবাদিক নাদিম যখন মোটরসাইকেল দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেন রেজাউল করিম।  

পরে কয়েকজন মিলে টানতে টানতে সাংবাদিক নাদিমকে মারধর করতে করতে নিয়ে যান বকশীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী গোলাম কিবরিয়া সুমনের দোকানে।  

সিনেমার দৃশ্যের মতোই পাশের অন্ধকার গলি থেকে লাথি দিয়ে দেয়াল ভেঙে ইট হাতে নিয়ে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করেন চেয়ারম্যানপুত্র ফাহিম। দোকানে প্রবেশ করেই নাদিমের মাথায় আঘাত করেন।

অপকর্ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে নাদিমের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেন সাধুরপাড়ার চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। পরে ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

জামালপুর জেলা দায়রা জজ আদালতে সাংবাদিক নাদিমের বিরুদ্ধে করা মামলা ১৪ জুন খারিজ হলে ফোনে হত্যার হুমকি দেন ফাহিম। এ সময় সাংবাদিক নাদিমের মেয়ে জান্নাত বাবার সঙ্গেই ছিলেন।

জান্নাত বাংলানিউজকে বলেন, হুমকি দিয়ে ফাহিম বাবাকে (সাংবাদিক নাদিম) বলেন ‘বাপ (চেয়ারম্যান বাবু) মামলা করেছেন, আমি হলে মেরেই ফেলতাম। ’

১৪ জুন রাতের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক গোলাম রাব্বানীর সহকর্মী আল মুজাহিদ বাবু বাংলানিউজকে বলেন, বকশীগঞ্জের পাথাটিয়া বাজারে পৌঁছালে অতর্কিতভাবে সামনে থেকে আঘাত করে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেওয়া হয় নাদিমকে। এরপর দেশীয় অস্ত্র হাতে ১০-১২ জন সড়ক থেকে নাদিমকে মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে অন্ধকারে নিয়ে যান।  

তখন তাদের আটকাতে গেলে মারধরের শিকার হন মুজাহিদ। হত্যার হুমকিও দেওয়া হয় তাকে। মুজাহিদ বলেন, এক পর্যায়ে লুঙ্গি পরা একটি ছেলে আমাকে মারধর করে।  

তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের লোকজন চাচ্ছিলেন সিসিটিভির আওতার বাইরে নাদিমকে নিয়ে যেতে। যে গলির পাশে যে দোকানে নাদিমকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে ছোট একটি ইটের দেয়াল ছিল। ইটের দেওয়ালের পেছনে চেয়ারম্যান মাহমুদ আলম বাবু দাঁড়িয়েছিলেন। আর তার ছেলে ফাহিম সেই ইটের দেয়াল লাথি দিয়ে ভেঙে সেখান থেকে একটি ইট হাতে নিয়ে আঘাত করেন নাদিমকে।

যেভাবে পুলিশের হাত থেকে ফসকে গেল ফাহিম

হামলার পরদিন ১৫ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাংবাদিক নাদিম মারা গেলে চেয়ারম্যান বাবুর ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাত নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ছবি পোস্ট করেন। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চান যে, তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন, হামলায় জড়িত ছিলেন না।

কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক মুজাহিদ বাবু গণমাধ্যমের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা দিয়ে চেয়ারম্যান বাবু ও ফাহিমকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন। এরপর মোবাইল ফোন বন্ধ করে গা ঢাকা দেন রিফাত।

সাংবাদিক নাদিমের পরিবার ও সহকর্মীদের দাবি, ১৪ জুনের হামলা, ১৫ জুন সাংবাদিক নাদিমের মৃত্যুর দিন, এমনকি ঘটনার পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ফাহিমকে গ্রেপ্তারে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

১৬ জুন বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ওসির বক্তব্যকে ভুল হিসেবে আখ্যা দেন জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ।

তিনি সেদিন বাংলানিউজকে বলেন, ওসি সত্যিকার অর্থে ভুল বলেছেন। এলআইসি টিম আমার আন্ডারে থাকে, টিম মাঠে আছে। লাইভে বলেছি, লোকেশন দেখছি, তারা কোনদিকে আছেন। তাদের পেছন পেছন যাচ্ছে। মাহমুদুল আলম বাবু কিলিং মিশনের নায়ক, সেটা প্রথম থেকেই জানি।

তিনি বলেন, মাহমুদুল আলম বাবুর ছেলে ইট দিয়ে নাদিমের মাথা থেঁতলানোর জন্যে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তখন তো অবশ্যই হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত।  

ফাহিমের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় যা বলেন ওসি

ফাহিমের গ্রেপ্তারের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা বাংলানিউজকে বলেন, ফাহিম ফয়সাল রিফাতের পাসপোর্ট নেই। এ ছাড়া আমাদের এসপি মহোদয় বলেছেন, তিনি সব জায়গায় এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য জানিয়ে দেবেন। এসপি সাহেব পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ ছাড়া তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগতভাবে সব সহায়তা নিচ্ছি। ছেলেটি অনেক চতুর, আধুনিক ছেলে তো। তবুও দেখা যাক আমাদের টিম কাজ করছে।

ফাহিমের পিস্তলসহ ছবি ভাইরাল

সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি চেয়ারম্যানপুত্র ফাহিম ফয়সাল রিফাত। সম্প্রতি তার হাতে পিস্তলসহ একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যায়, আকাশি রঙের শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট পরিহিত রিফাত ডান হাতে পিস্তল নিয়ে একটি মাঠে কারো সঙ্গে দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছেন। তার পেছনে ধান ক্ষেত।

এ নিয়ে বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহেল রানা জানান, ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি। এখনও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। গ্রেপ্তার হলে এ অস্ত্রের রহস্য বেরিয়ে আসবে। যদি তার কাছে অস্ত্র পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাবু পরিবার কেন পুলিশের এত ঘনিষ্ঠ 

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর চাচাত বড় ভাই মোখলেছুর রহমান পান্না পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি ছিলেন।  

এ ছাড়া বাবুর বড় বোনের ছেলে রেজুয়ান দিপু সহকারী পুলিশ সুপার বলেও জানা গেছে। বাবুর পলাতক ছেলে ফাহিমের সঙ্গে তার একাধিক ছবিও রয়েছে।

ওসি-এসপির প্রত্যাহার দাবি

পুলিশ প্রশাসন কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন- এমন অভিযোগে জামালপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) নাছির উদ্দিন আহমেদ ও বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহেল রানার প্রত্যাহার দাবি করেছেন ইসলামপুর প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকেরা।

একই দাবি করেছে সাংবাদিক ইউনিয়ন বরিশালসহ দেশের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন।  

আগেও এসপির বিরুদ্ধে ছিল সাংবাদিক পেটানোর হুমকির অভিযোগ 

২০২১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদের প্রত্যাহারের দাবিতে টানা দুই সপ্তাহ আন্দোলন চলে।

সে সময় জামালপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শোয়েব হোসেন বলেছিলেন, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) মেলা সম্পর্কে জানানোর জন্য সাংবাদিকদের ডাকেন এসপি নাছির।  

এ সময় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত না হওয়ায় এসপি ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ধরে এনে পিটিয়ে চামড়া তুলে নেওয়ার হুমকি দেন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাগর ফরাজী 
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬, জুন ২০, ২০২৩
এনবি/এসএফ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।