ঢাকা: প্রতিবছর কোরবানির ঈদ এলেই চাহিদা বেড়ে যায় দা, বটি, ছুরি, চাপাতি, কুড়ালসহ গোশত কাটার বিভিন্ন সরঞ্জামের। ক্রেতার চাহিদা মেটাতে ব্যস্ততা বাড়ে কামারদেরও।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কামারপট্টিতে বেড়েছে ব্যস্ততা। তবে সেই অনুযায়ী বিক্রি বাড়েনি। ফলে কিছুটা হতাশ পেশাটির সঙ্গে জড়িতরা। আশা করছেন, ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেচা-বিক্রিও বাড়বে।
কারওয়ান বাজারের রেললাইন সংলগ্ন কামারপট্টিতে গিয়ে দেখা যায়, ১৪টি কামারের ঘরসহ প্রায় ২৪-২৫টি দোকান রয়েছে এখানে। প্রতিটি দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কোরবানির পশু জবাই ও গোশত কাটার বিভিন্ন আকারের দা, বটি, ছুরি, চাপাতি, কুড়াল। অধিকাংশ দোকানের ভেতর থেকে ভেসে আসছে হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটানোর টুং টাং শব্দ।
অনেকে আবার দোকানের সামনে বসে এসব সরঞ্জাম ধারালো করতে শান দেওয়ার কাজ করছেন। দোকানের পাশ দিয়ে কেউ গেলেই ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, কী লাগবে? টুকটাক যেসব ক্রেতা আসছেন তাদেরকে চাহিদা অনুযায়ী সরঞ্জাম দেখাচ্ছেন, দামাদামি করছেন। সবমিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার কামার ও বিক্রেতারা।
ব্যস্ততার পাশাপাশি কিছুটা বিক্রিও হচ্ছে। যদিও সেটি প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। কারণ হিসেবে কামার ও বিক্রেতারা বলছেন, এবার দা, বটি, ছুরি, চাপাতিসহ সব ধরনের সরঞ্জামের দাম বেশি। তাই যাদের খুব প্রয়োজন, শুধুমাত্র তারাই নতুন করে কোরবানির পশু কাটার সরঞ্জাম কিনছেন। বাকিরা পুরনো যেসব সরঞ্জাম আছে, সেগুলোই নতুন করে শান দিয়ে ধারালো করে নিচ্ছেন।
এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতিকেও বেচাবিক্রি কম হওয়ার জন্য দায়ী করছেন তারা।
কামারপট্টির মা জননী দোকানের বিক্রেতা মো. মেহেদী হাসান মিরাজ বলেন, সাধারণ সময়ের তুলনায় কোরবানির ঈদকে ঘিরে বেচাবিক্রি কিছুটা হচ্ছে। তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার কম। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মানুষ এসব জিনিস কিনতে ভয় পাচ্ছে। তাছাড়া মানুষের কাছে টাকা নেই, এদিকে প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি।
সঞ্জয় চন্দ্র গোস্বামী নামের এক কামার বলেন, রোজার ঈদের এক মাস পর থেকেই আমরা কোরবানির জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। আগে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও এখন টানা ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। মাঝে শুধু খাওয়ার সময় পাওয়া যায়। নাইলে চাহিদা অনুযায়ী মালামাল দেওয়া যায় না। এবারও একইভাবে কাজ করছি। কিন্তু এবার সেভাবে মালামাল বিক্রি হচ্ছে না।
কামারের এক সহযোগী মো. রুবেল বলেন, সকাল ৯টা থেকে কাজ শুরু করি। কখনো কখনো রাত ১১টা-১২টা বেজে যায়। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এভাবে কাজ করতে হবে। প্রতিদিন ২০-৩০টি দা, বটি, ছুরি, চাপাতি তৈরি করি। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে মোটামুটি বিক্রি হলেও এবার বিক্রি কিছুটা কম।
জনতা ট্রেডার্স ও নোয়াখালী হার্ডওয়্যারের মালিক মো. মানিক বলেন, আগে যেখানে এ সময় ২০-৩০ হাজার টাকা বিক্রি করতাম, এখন সেখানে পাঁচ হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারছি না। একদিকে এসব জিনিস তৈরির কাঁচামালের দাম বেশি, অন্যদিকে কামারসহ শ্রমিকদের মজুরিও বেশি। তাই মালের দাম এবার কিছুটা বেশি। কিন্তু ক্রেতা নেই। আবার অনেকে এখন আর হাটে আসেন না। অনলাইন থেকে কিনে ফেলেন। যার কারণে আমাদের ব্যবসা খারাপের দিকে।
সুনীল কর্মকার নামের আরেক কামার বলেন, আগে যেই লোহা ১৫০ টাকা কেজি কিনতাম, সেটি এখন ২০০ টাকা। কয়লা আগে ছিল ৯০০ টাকা, এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা। শ্রমিকদের মজুরি ছিল আগে ৬০০ টাকা এখন সেটি ৮০০ টাকা হয়েছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কিন্তু এই দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা আসছেন না। পুরাতন জিনিস দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী হারুনুর রশিদ। পুরানো ছুরি, চাপাতি, বটি শান দিতে নিয়ে এসেছেন কারওয়ান বাজারের কামারপট্টিতে।
তিনি বলেন, এবার সরঞ্জামের যেই দাম, তাই আগেরগুলোই ধার দিয়ে নিচ্ছি। এমনিতেই বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। নতুন করে এখনে টাকা খরচ করার সুযোগ নেই। তাই আগেরগুলো দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। শুধু নতুন করে একটি চাপাতি কিনতে হয়েছে।
সাকিবুল হাসান নামের আরেক ক্রেতা বলেন, গত বছর যেই চাপাতি ৬৫০ টাকায় কিনেছি, এবার সেটি কিনতে হয়েছে ৮০০ টাকা দিয়ে। দাম অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও কিনতে হবে, তাই কিনেছি। আরও কিছু জিনিস কেনার দরকার ছিল। কিন্তু দামের কারণে এখন আর কিনবো না। বাসায় গিয়ে পুরানোগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
এ কামারপট্টিতে বর্তমানে মান ও আকারভেদে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে এসব লোহার সরঞ্জাম।
এর মধ্যে ওজনভেদে প্রতিটি চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, দা ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা, বড় ছুরি ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ছোট ছুরি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা, কোপ ছুরি ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা, রেত ছুরি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, কুড়াল ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা, চাইনিজ কুড়াল ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, বটি ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০২৩
এসসি/এমএইচএস