পাবনা: ‘দশ বছর ধরে মায়ের খোঁজ রাখেন না কোটিপতি ছেলে’ - এমন শিরোনামে কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি নজরে আসে স্থানীয় প্রশাসনসহ সচেতন সমাজের।
পরে পাবনার চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল ও নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবণী রায়ের হস্তক্ষেপে অভিমান ভাঙে কোটিপতি ছেলের।
দীর্ঘ দশ বছর মায়ের সঙ্গে দেখা করে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন সেই ছেলে আব্দুল মোতালেব।
শতবর্ষী মা আমেনা বেগমকে ছেলের জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য এক আবেগাপ্লুত পরিবেশের সৃষ্টি করে।
পাবনার চাটমোহরে ছাইকোলা ইউনিয়নের চর এনায়েতপুর গ্রামে পলিথিনে ঘেরা নাতনি রমেছার ভাঙা ছাউনিতে থাকেন আমেনা বেগম। আর অভিমানী কোটিপতি ছেলে মোতালেন থাকেন শ্বশুরবাড়ি এলাকা নাটোরের গুরুদাসপুরে অট্টালিকায়।
স্থানীয়রা জানায় , গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবণী রায় গত সোমবার (১০ জুলাই) দুপুরে আব্দুল মোতালেবকে তার অফিসে ডাকেন এবং চাটমোহর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল তাকে মোবাইল ফোনে ধর্মীয় ও আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে তার মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। সেই সঙ্গে তাকে সতর্ক করে দেন।
এরই ফলশ্রুতিতে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সকালে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামানকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করেন ছেলে মোতালেব। এসময় মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলে। এসময় উপস্থিত অনেকের চোখে গড়িয়ে পড়ে আনন্দ অশ্রু। এরপর ছেলে মায়ের কাছে ক্ষমা চান এবং সবার সামনে মায়ের ভরণপোষণের প্রতিশ্রুতি দেন।
দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় মায়ের কোনো খোঁজখবর রাখেননি আব্দুল মোতালেব। এমনকি মায়ের মুখ পর্যন্ত দেখেননি তিনি এ সময়ের মধ্যে।
মাকে ছেড়ে ছেলের এভাবে চলে যাওয়া ও মায়ের কোনো খোঁজখবর না রাখার বিষয়ে জানা গেছে, নাতনি রমেছাকে ১০ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছিলেন আমেনা বেগম। এতেই অভিমান করে নাটোরে চলে যান মোতালেব।
ছেলে ফেলে গেলেও ফেলতে পারেননি নাতনি রমেছা খাতুন (৩৫)। একই উপজেলার ছাইকোলা কানাইয়েরচর গ্রামে নাতনি রমেছা খাতুনের কাছে ঠাঁই হয় শতবর্ষী ওই বৃদ্ধা আমেনার।
এদিকে হতদরিদ্র নাতনি-নানির সংসার চলে না। শতবর্ষী আমেনা বেগমের দিনরাত কাটে ঘরের বাইরের পলিথিনে ঘেরা একটি ছাউনিতে। সেখানেই অতিকষ্টে চলছে তার জীবন সংগ্রাম। তাতেও ওই মায়ের কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট একটাই ছিল - তা হলো তার ছেলেকে এক নজর দেখার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাচকৈড় বাজারে বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করেন আব্দুল মোতালেব। পেশায় ওষুধ ব্যবসায়ী তিনি।
তবে এই ঘটনা এলাকাবাসী ভালোভাবে নিতে পারেননি। ছেলে মোতালেবের এমন কাণ্ডের বিচার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। ফেসবুকের সেই পোস্টগুলো মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। চারিদিকে বইতে থাকে নিন্দার ঝড়।
এ ব্যাপারে আব্দুল মোতালেব বলেন, আমার অন্যায় হয়েছে। এখন থেকে মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। আশা করি মা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
সেই সঙ্গে ভাগনি রমেছাকেও ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। বলেন, এতদিন ধরে কষ্ট করে আমার মাকে দেখে রাখার জন্য রমেছাকে ধন্যবাদ।
এ ব্যাপারে রমেছার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি নানির পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ। নানা আমার নামে ১০ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছিলেন কিন্তু সেই জমি তো আমার মামা (মোতালেব) দখল দেননি। কিন্তু তাই বলে, মায়ের মুখ দেখতে আসবে না? অবশেষে মামা এসেছেন তাতে নানির মতো আমিও খুব খুশি। আমি নানার দেওয়া সেই ১০ শতাংশ জমি মামাকে ফেরত দিতে চাই।
ছাইকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরু বলেন, বৃদ্ধা ও তার ছেলেকে মিল করে দিতে পেরে ভালো লাগছে। বৃদ্ধ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হলো ছেলে।
চাটমোহর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল বলেন, মাকে ভরণপোষণের জন্য বলা হয়েছে ছেলে আব্দুল মোতালেবকে। তার কাছে রেখে অথবা অন্য কারও মাধ্যমে হলেও মাকে দেখভাল করতে নির্দেশনা দিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২৩
এসএএইচ