বগুড়া: বগুড়ায় অল্প বয়সেই ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। ইভটিজিং, জমি দখল, চাঁদাবাজি, জখম, ছিনতাই ও এমনকি খুনের অপরাধে জড়িত হচ্ছে তারা।
কিশোর অপরাধের অন্যতম কারণ দরিদ্রতাকে উল্লেখ করা হলেও বগুড়ায় এর প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন।
জেলায় অভিভাবকদের অবহেলা-প্রশ্রয়ে দিন দিন কিশোর অপরাধ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। পরিবারের কাছে আবদারেই স্বপ্নপূরণ হচ্ছে ওইসব কিশোরদের। আর এতেই বাড়ছে তাদের দৌরাত্ম্য।
বগুড়া জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. নূহ্ বাংলানিউজকে বলেন, বগুড়ায় কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে বগুড়া জেলায় এখন কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িত অনেক শিশু-কিশোর যশোর জেলার পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে। অনেকে জামিনে রয়েছে। তারা বিভিন্ন অপরাধ যেমন, মারামারি, হত্যা, চুরি, ছিনতাইসহ একাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথাসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে তৎপর কিশোর অপরাধীরা। রেজিস্ট্রেশন ও লুকিং গ্লাসবিহীন মোটরসাইকেলে চেপে শহরে কোনো কারণ ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব কিশোর।
উচ্চ শব্দের সাইলেন্সার ব্যবহার করে মোটরসাইকেলযোগে তারা শহরের গার্লস স্কুলকলেজ, কোচিং সেন্টার সংলগ্ন এলাকা এবং বিভিন্ন মোড়ে আড্ডার সঙ্গে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।
এসব কিশোরদের বেশভুসাতেই রয়েছে বখাটেপনা। তাদের চোখে সানগ্লাস, মুখে হালকা দাঁড়ি, গলায় চেইন, টি-শার্ট ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে শহরময় ঘুরে বেড়ায় তারা।
দামি মোবাইল ফোন আর বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে এলাকায় ত্রাস আর ভীতি সৃষ্টি করছে এসব কিশোরেরা।
এদের মধ্যে অনেকে স্কুল ব্যাগে বই-খাতার সঙ্গে থাকে মাদক ও ধারালো ছুরি।
স্থানীয়রা মনে করেন, পরিবারের অসচেতনতায় কিশোররা জড়াচ্ছে গুরুতর সব অপরাধ কর্মকাণ্ডে।
বগুড়ায় কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। তবে শহরে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। মানুষকে মারধর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ভয়ংকর হয়ে উঠছে এ কিশোর গ্যাংগুলো। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবনে।
সিগারেট থেকে শুরু হচ্ছে তাদের নেশার জন্ম। ধীরে ধীরে আসক্ত হচ্ছে অন্যান্য নেশায়। সেই সঙ্গে মাদক সেবন থেকে জড়িয়ে পড়ছে বিক্রিতে। স্কুলকলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে মিশে একত্র হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত অছাত্র কিশোররা। তাদেরকে দলে এনে তৈরি করছে এক একটি গ্রুপ। আধিপত্য নিয়ে চলছে নানান অপরাধ কর্মকাণ্ড।
বগুড়া শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও এলাকাবাসী নির্যাতনের শিকার হওয়া অনেকেই জানান, তারা সবসময় এসব কিশোর অপরাধীদের ভয়ে নিজেদের সহায়-সম্পদ, উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করতে আসে, স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের দলে ভিড়িয়ে ফেলে - এসব দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম অভিভাবকদের।
সমাজের নিরীহ অংশ বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি।
এলাকাবাসী জানান, তারা সময় আমরা এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করলেও বিপদ। পরবর্তীতে তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কিশোর অপরাধীরা। অভিযোগ করলে কোন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে আসার আগে এসব কিশোর অপরাধীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
তবে কিশোর গ্যাংদের দৌরাত্ম্য থামাতে তৎপর পুলিশ। বগুড়ায় প্রতিনিয়তই শহর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের টহল চলমান রয়েছে। তবুও থামছে না কিশোর অপরাধ।
বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি ইসলাম রফিক বাংলানিউজকে বলেন, সামাজিকভাবে প্রতিরোধ এবং আইনের আওতায় আনা না গেলে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বাড়বে। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা যদি সচেতন ও স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা যদি দায়িত্বশীল এবং স্কুল-কলেজে নজরদারি বাড়ানো হয় তাহলে অনেকাংশে কমে আসবে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা।
তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সন্তানদের পাঠ্যবই ব্যতীত বিভিন্ন বই (কবিতা, সাহিত্য, গল্প) এবং দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত পাঠের অভ্যাস করতে হবে। তাহলে অপরাধ কমে আসবে।
বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট নরেশ মুখার্জি বাংলানিউজকে বলেন, পরিবারের সদস্যদের প্রশ্রয়, অসচেতনতা-অবহেলার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। শিশু-কিশোর অপরাধ কমাতে বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কেননা তাদের কারাগারে আটকে রেখে বিচার করা যায় না, জামিনের বিধান আছে। এক্ষেত্রে পুলিশের বিশেষ কিছু করার থাকে না।
বগুড়া জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. নূহ্ বলেন, সারাদেশে শিশু-কিশোর সংঘটিত অপরাধের বিস্তার ঘটার পেছনে দারিদ্র, অশিক্ষাসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক, পারিবারিক ও মনস্তাত্বিক ডাইমেনশন রয়েছে।
তিনি বলেন, শিশু অপরাধের বিস্তৃতি রোধকল্পে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ব্যাপক সামাজিক গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া এখন শিশু অপরাধীদের হেফাজতের জন্য বাংলাদেশে মাত্র তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে, এর পরিমাণ এবং জনবল বাড়াতে হবে।
জেলা পুলিশের মিডিয়া ও মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শরাফত ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, কিশোর গ্যাং এবং কিশোর অপরাধের দৌরাত্ম্য ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট অপরাধসমূহ নির্মূলের জন্য জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বিট পুলিশের মাধ্যমেও এটি রোধ কল্পে কাজ করা হয়। তবে কিশোর গ্যাং নির্মূল করতে মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য পরিবারের লোকজন হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। পরিবার থেকেই তাদের বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিশোর অপরাধ রোধকল্পে সচেতনতা মূলক আলোচনা প্রয়োজন। কিশোর অপরাধ কর্মকাণ্ড দমন করতে সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২৩
কেইউএ/এসএএইচ