ঢাকা, সোমবার, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মধ্যরাতে লাইট জ্বালানো নিয়ে বিবাদের জেরে চাচা-ভাতিজাকে খুন!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২৩
মধ্যরাতে লাইট জ্বালানো নিয়ে বিবাদের জেরে চাচা-ভাতিজাকে খুন!

ঢাকা: রাজধানীর পুরান ঢাকার কদমতলী এলাকায় কথা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রেসে দুটি হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় বছর পর রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিবিআই বলছে, টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া এলাকার প্রতিবেশী চাচা-ভাতিজা একই প্রেসে কাজ করা অবস্থায় খুন হন।

কিন্তু এ খুনকে চাচার হাতে ভাতিজা খুন ও পরে চাচার আত্মহত্যার নাটক সাজান হত্যাকারীরা।

অবশেষে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করেন পিবিআইর তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ ঘটনায় ১১ আসামির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

বুধবার (০২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটনের বিস্তারিত তুলে ধরেন সংস্থার প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।  

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নিহত সোহেল ও তার প্রতিবেশী চাচা ইকবাল হোসেন পুরান ঢাকার কদমতী থানার কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসে কাজ করতেন। পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মচারীরাও কারখানায় থাকতেন।

২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর প্রেসের এক কর্মচারী ফোন কল করে জানান, রাত ৩টার দিকে সোহেলকে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে ইকবাল পালিয়ে গেছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রেসের মালিক ও কর্মচারীরা সোহেলকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনায় সোহেলের ছোট ভাই সাইদুর রহমান বাদী হয়ে ইকবালের (৫৫) নামে কদমতলী থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। পরে ৮ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোহেল মারা যান।

প্রেস কর্মচারীরা থানা পুলিশ ও নিহতদের স্বজনদের জানিয়েছে, ৬ নভেম্বর রাত ৩টার দিকে চাচা ইকবাল নামাজ পড়তে ওঠেন। এ সময় রুমের লাইট জ্বালানোকে কেন্দ্র করে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্ব হয়। এ সময় লোহার রড দিয়ে ইকবাল তার ভাতিজা সোহেলকে গুরুতর আহত করে পালিয়ে যান।

এর ৫ দিন পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকার বিক্রমপুর স্টিল মিলের পাশে গাছের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ইকবালের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাকে প্রেসের কর্মচারীরা প্রচার করেন, নিজের অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে ইকবাল আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে পুলিশ।

কদমতলী থানায় দায়ের হওয়া মামলার একমাত্র আসামি ইকবালের মরদেহ উদ্ধার হওয়ায় ২০১৮ সালে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এদিকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ইকবালের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি হত্যা উল্লেখ করায় প্রেসের ১০ কর্মচারীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন ইকবালের স্ত্রী পারভীন বেগম।

মামলাটি রূপগঞ্জ থানা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে ছয় প্রেস কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু কোনো ধরনের তথ্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।

যেভাবে রহস্যে জট খোলে পিবিআই:

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ইকবাল হত্যা মামলার তদন্তে নেমে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কারখানায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া গাড়ির খোঁজে নামেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গাড়ি ও সেই সময়ে গাড়ির চালক নুর আলম ও তার মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়। কিন্তু নুর আলমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি অন্য এক চালকের। নুর আলম নিজেকে আড়াল করতে অন্যের নাম্বার ব্যবহার করেন।

নুর আলম আটকের পর পিবিআই জানায়, ২০১৭ সালে তিনি মো. বাদল মিয়ার পিক আপভ্যান চালাতেন।

নুর আলম ও বাদল মরদেহ গুম করার কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, প্রেসের কর্মচারীরাই ইকবালকে হত্যা করেন। পরবর্তীতে নুর আলম ও বাদল মরদেহ গুমের কাজে তাদের সহযোগিতা করেন। পরে তারা আদালতে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জোড়া খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়।

পিবিআইয়ের তদন্তে হত্যার মূল রহস্য বেরিয়ে আসে উল্লেখ করে পিবিআই প্রধান বলেন, নিহত ইকবাল ছিলেন পরহেজগার ও নামাজি ব্যক্তি। তিনি নামাজের জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। আর কর্মচারীরা রাত জেগে মধ্যরাতে ঘুমাতে যেতেন। এ সময় রুমের লাইট জ্বালাতেন ইকবাল। আর এ লাইট জ্বালানো নিয়ে অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে প্রায়ই ইকবালের বাকবিতণ্ডা হতো।

ঘটনার দিন ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর রাত ৩টায় প্রথমে প্রেস কর্মচারী আ. রহমানের সঙ্গে ইকবালের ঝগড়া, হাতাহাতি হয়। এ সময় অন্য কর্মচারীরাও ইকবালকে মারধর করেন। দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের ফলে তারা সবাই মিলে ইকবালকে মারধর ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।

তখন তার প্রতিবেশী ভাতিজা সোহেল ইকবালকে বাঁচাতে গেলে আসামিরা তাকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাতারি মারধর করে আহত করেন। এরপর আসামি জামাল তার পূর্ব পরিচিত পিকআপ ভ্যানচালক নূর আলম ও গাড়ির মালিক বাদলের সঙ্গে কথা বলে ২০ হাজার টাকায় পিকআপভ্যান ভাড়া করেন।

পিকআপ মালিক বাদল ও চালক নূর আলম পিকআপ ভ্যানটি প্রেসে নিয়ে আসে। একদিন পর ইকবালের মরদেহটি পিকআপ ভ্যানে করে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জের বরপায় নিয়ে লাশের গলায় গামছা পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে।

পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জমান মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সোহেল হত্যার মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়ে যাওয়ার পরেও পুনঃ তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন। আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিলে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) মামলাটি তদন্ত করে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) সোহেল হত্যা মামলায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার ও শোন অ্যারেস্ট করে। দুটি মামলাতেই তদন্তে হত্যা ও মরদেহ গুমের সঙ্গে মোট ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পায় পিবিআই। তবে হত্যায় জড়িত এক আসামির মৃত্যু ও দুজন পলাতক রয়েছে। এ দুটি মামলাতেই দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলেও জানান পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২৩
পিএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।