বাগেরহাট: বাগেরহাটের মোংলা, রামপাল, খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলার ছুয়ে বয়ে যাওয়া পশুর নদীর একটি চরের নাম কৈগরদাসকাঠি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কিছু ভূমিহীন ও হতদরিদ্র মানুষ বসবাস শুরু করেন এই চরে।
বসতি বাড়লেও সুযোগ সুবিধা বাড়েনি। সময় গড়ালেও এখানে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষ ভূমিহীনই রয়ে গেছেন। শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, মাথাপিছু আয়, চিকিৎসা সেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবন যাত্রার মানসহ সব দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছেন তারা। এর সাথে সুপেয় পানির তীব্র সংকট, জলাবদ্ধতা, শিশুশ্রম, বেকারত্ব, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতননের মত সামাজিক ব্যাধি তো রয়েছেই। যখন তখন বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারানোর শঙ্কাও রয়েছে তাদের। সরকারি সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। এক কথায় অবহেলিত এক জনবসতির নাম কৈগরদাসকাঠি গ্রাম।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা সদর থেকে ১২ থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চরের পশ্চিমে পশুর নদী ও দাকোপ উপজেলা, পূর্বে কাপাসডাঙ্গা গ্রাম, দক্ষিনে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, উত্তরে বটিয়াঘাটা উপজেলা। কৈগরদাসকাঠি এলাকালায় প্রবেশ করলেই চোখে মিলবে ছন ও মাটির তৈরি ছোট ছোট ঘর। দেখে মনে হতে পারে মৎস্য ঘেরের চৌকিদারি বাসা। এসব ঘরেই বসবাস করেন কৈগরদাসকাঠির বাসিন্দা। ইটের ভবন ও বা কাঠের ফ্রেমে টিনের ছাউনি ওয়ালা ঘর নেই বললেই চলে।
কৈগরদাসকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম আশ্রয়ন কেন্দ্রের অদূরে চরের জমিতে মাটির দেওয়াল ও গোলপাতার ছাউনির ঘরে বসবাস করেন ৪৫ বছর বয়সী মোঃ ফেরদাউস ফকির। দ্বিতীয় স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক ছেলের বউ পাঁচজন মিলে থাকেন এই ঘরে। ঘরের মধ্যে একটি মাত্র খাটে থাকেন ১৯ বছর বয়সী ছেলে জিন্নাত ও তার স্ত্রী শারমিন বেগম (১৫)। ১৬ বছর বয়সী বাক প্রতিবন্ধী ছেলে ইরাত ফকিরকে নিয়ে ঘরের মেঝেতে থাকেন বাবা-মা। চালে দেওয়া গোলপাতা কয়েকবছরের পুরোনো হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে ভিজতে হয় তাদের। বৃষ্টি ঠেকাতে পলিথিনও দিয়েছেন চালে।
ঘরের এই অবস্থা কেন জানতে চাইলে মোঃ ফেরদাউস ফকির বলেন, তিন বেলা খাবারই জোটে না, তারপর ঘর। এর উপরে ছোট ছেলেটা প্রতিবন্ধী। সব কাজ করতে পারে না। অভাবের তারণায় তো বড় বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলেই গেছে। আল্লাহ যেভাবে রাখেন সেভাবে থাকি। ফেরদাউসের স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, অনেক কষ্টের জীবন আমাদের। ১৩ বছরে বিয়ের পর থেকে কষ্ট শুরু করেছি, এখনও করছি। যতদিন বেঁচে থাকব তদদিন করতে হবে।
ফেরদাউসের ঘর থেকে কিছু দূরে মধ্যবয়সী জাহানারা বেগমের ঘর। জাহানারার ঘরেরও একই অবস্থা। বড় মেয়ে গার্মেন্টস-এ চাকরি করে, ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ১৩ বছর বয়সে। কেমন আছেন জানতে চাইলে, জাহানারা বলেন, খুবই কষ্টে আছি। নদীতে মাছ নেই, লোকালয়ে কাজ নেই। হাস-মুরগিতে কি সংসার চলে! শুধু জাহানারা ও ফেরদাউস ফকিরের নয়, এই চরে থাকা ৪ শতাধিক পরিবারেরই একই অবস্থা। নুন আনতে পান্তা পুড়ায় বাক্যটি যেন এই গ্রামের মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে।
পশুর নদী, পাশ্ববর্তী খাল, ধানের জমিতে মাছ ধরার পাশাপাশি চরের সরকারি জমিতে মাছ চাষের সাথে যুক্ত এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা। তবে নদীতে এখন আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না। সারাদিন চেষ্টা করেও, ৫-৬শ টাকার মাছ ধরা কষ্টের বলে জানালেন রবিউল নামের এক জেলে। তিনি বলেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করার পরে মাছ ধরার জায়গা যেমন কমেছে, তেমনি নদী-খালেও আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। শীত মৌসুমে মাছের ঘের প্রস্তুতের সময় ছাড়া বাকি সময় তেমন কোন কাজ থাকে না এলাকায়। অনেক দূরে দূরে যেতে হয় কাজের সন্ধানে। সেখানো রয়েছে নানা জটিলতা।
এখানে স্কুলে যায়না গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে। কৈগরদাসকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামে ১১৩ জন শিশু রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার মত। এদের মধ্যে মাত্র ৬৪ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি রয়েছেন। নিয়মিত স্কুলে যায় ৩০ থেকে ৩৫জন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য ১০৭ জন ছেলেমেয়ে থাকলেও, বেশিরভাগই স্কুলে যায় না।
এই অবস্থার কারণ সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক রেকসোনা খাতুন বলেন, বেশিরভাগ অভিভাবক হতদরিদ্র এবং লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝেন না। সংসারে স্বচ্ছলতার জন্য ছোট বয়সেই নদীতে মাছধরা, ইটভাটা ও বিভিন্ন হোটেলে কাজে দিয়ে দেয়। পারিবারিক কলহের কারণে বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ায়, শিশুদের পড়াশুনা আর এগোয় না। অনেক বুঝিয়েও স্কুলে আনা যায় না বাচ্চাদের। শিশুদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে বাবা-মায়ের সচেতনা বৃদ্ধির উপর জোর দেন তিনি।
মোঃ নুরুল ইসলাম গাজী নামের এক অভিভাবক বলেন, এখানের শিশুদের শিক্ষিত এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভাল রাখতে হলে বয়স্ক মানুষদের সচেতন করতে হবে। বয়স্ক স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে অভিভাবকদের আগে পড়াশুনা শেখাতে হবে, তাদেরকে পড়াশুনার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। তাহলেই বাচ্চাদের পড়াশুনা হবে এবং বাল্য বিবাহ বন্ধ হবে বলে দাবি এই ব্যবসায়ীর।
এই গ্রামে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই, নেই কমিউনিটি ক্লিনিকও। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যেতে হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামে। গর্ববতী মায়েদের সেবাসহ একটু জটিল সমস্যা হলেই নদী পাড় হয়ে দাকোপ যেতে হয় নয়ত ১২ কিলোমিটার দূরে রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। এসব জায়গায় যেতে গিয়ে অনেক সময় রোগী ও স্বজনরা অন্য সমস্যায়ও পরে থাকেন। হালিমা বেগম নামের এক নারী বলেন, রাস্তার যে অবস্থা তাতে সুস্থ মানুষ ভ্যানে গেলে অসুস্থ হয়ে যায়। আর অসুস্থ মানুষকে যখন ভ্যানে করে হাসপাতালে নিতে হয়, তা যে কত কষ্টের তা যে অসুস্থ্য হয় সেই যানে। একবার অসুস্থ অবস্থায় এই পথে গিয়েছিলাম, তখন মনে হয়েছে এই রোগের থেকে মরে যাওয়াই ভাল ছিল।
এখানে সুপেয় পানির প্রধান মাধ্যম বৃষ্টি। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলে এলাকায় থাকা একমাত্র নলকূপের ওপর ভরসা করতে হয়। যার ফলে সারাবছরই মোটামুটি পানি বাহিত রোগ লেগে থাকে। অন্যদিকে বছরের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেশিরভাগ এলাকা জলমগ্ন থাকে। কারণ গ্রামের পশ্চিমে পশুর নদীর তীরে রাস্তা হওয়ায় এখন আর বৃষ্টি ও অতিরিক্ত জোয়ারের পানি নদীতে নামতে না পারায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে জানান জাহানা বেগম। সুপেয় পানির সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ট্যাংকি স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা।
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু সনদসহ অন্যান্য সেবা পেতে বিলম্ব ও ভোগান্তির শিকার হওয়ার এখানে সাধারণ ঘটনা।
নিজ এলাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের খবরে আশায় বুক বেঁধেছিল কৈগরদাশকাঠিবাসী। কিন্তু এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তাদের কোন উপকারে আসেনি। স্থানীয় শেখ আমজাদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এলাকার তেমন কেউ কাজ করতে পারে না। সবাই বাইরে থেকে এসে কাজ করে। বরং কেন্দ্র হওয়ার আগে ওই জমিতে আমরা ধান চাষ ও মাছ ধরে খেতাম। ধান রোপণ, কাটা ও মাছের ঘের প্রস্তুতের জন্য অনেক শ্রমিক লাগত। সেগুলো এখন আর লাগে না। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ওই এলাকায় ১ হাজার ৮শ ৩৪ একর বিলান জমি অধিগ্রহণ করা হয় বলে জানা যায়।
এই চরে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নারীরা। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, বিভিন্ন সময় এই চরে হেনস্তা ও যৌন নীপিড়নের মুখে পড়েছেন অন্তত ২০ জন নারী, কিশোরী ও মেয়ে শিশু। এছাড়া নারীদের কানের দুল, সঞ্চিত অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ঘরবাড়ির অবস্থা খারাপ হওয়ায় সহজেই অপরাধীরা প্রবেশ করতে পারে ঘরে। এছাড়া কাজের জন্য বাড়ির পুরুষরা এলাকার বাইরে গেলে ঝুকির মধ্যে থাকতে হয় নারী ও কিশোরী মেয়েদের। প্রতিকার না থাকা এবং প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন নারীরা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, চরে কয়েকজন বনদস্যু থাকেন। যারা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অলিখিতভাবে চরটি নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের উচ্ছেদ করতে পারলে সামাজিক সমস্যা অনেকটা দূর হবে।
এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, সুপেয় পানির নিশ্চয়তাসহ হতদরিদ্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি হিসেবে এলাকার মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার দাবি কৈগরদাশকাঠিবাসীর।
স্থানীয় ইউপি সদস্য এস.এম এ হালিম বলেন, পানির সংকট দূর করার জন্য ট্যাংকি ও টিউবওয়েল স্থাপন প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ ও ঝড়ে পড়া বাচ্চাদের স্কুল মুখী করতে শিক্ষকদের আন্তরিকতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিবুল আলম বলেন, কৈগরদাশকাঠি একটি পিছিয়ে পড়া এলাকা। শিক্ষার অভাব, আর্থিক অনটনসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তবে ওই এলাকার জন্য বিশেষ কোন কর্মসূচি আমাদের নেই। অনগ্রসর এলাকাকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য সরকার যখন যে কর্মসূচি নেয়, আমরা তাই বাস্তবায়ন করি। এছাড়া ওখানে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির বিষয়ে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২৩
এমএম