চাঁদপুর: চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ অফিসের পাশেই নিজস্ব অফিস খুলে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন সোহেল রানা ওরফে সোহেল মাস্টার নামের এক সহকারী শিক্ষক।
২০১৯ সাল থেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমানের প্রতিনিধি পরিচয় ব্যবহার করে সেই অফিসে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তিনি।
অথচ পাশেই পড়ে থাকা আ.লীগের অফিস কার্যত বন্ধ।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বেশ ক্ষুব্ধ। এলাকাবাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, সোহেল মাস্টার ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেছেন। কিশোর গ্যাং, ইভটিজার, মাদক কারবারি কিশোর ও তরুণদের নেতা সোহেল। পেশায় শিক্ষক হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি পরিচয়ে নানান অপরাধমূলক কাজে জড়িত সোহেল।
স্থানীয় পত্রিকা অনলাইনে তার বিরুদ্ধে ‘কিশোর গ্যাংয়ের মূল নায়ক সোহেল মাস্টার’ শিরোনামে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদগঞ্জের রূপসা উত্তর ইউনিয়নের রুস্তমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এই সোহেল মাস্টার। এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুটি মামলাও হয়েছে। আর দুটি মামলাই আদালতে চলমান।
২০১৯ সালে সাবেক এমপি ড. শামছুল হক ভুঁইয়ার গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় মামলার আসামি এই সোহেল। এরপর ২০২০ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় হামলার ঘটনায়ও আসামি তিনি।
তবে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নামে অফিস খুলে বসা সোহেল স্থানীয় এমপির প্রতিনিধি, বিষয়টির সত্যতা মিলেছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ফরিদগঞ্জ উপজেলায় প্রত্যেক ইউনিয়নে স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাজ করার জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। তার মধ্যে সোহেল রানা অন্যতম।
এসব বিষয়ে স্থানীয় আ.লীগের ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সোহেল রানার অফিসে সরকারি টিআর, কাবিখা, বিভিন্ন ভাতা বণ্টনের কাজ হয়। একইসঙ্গে করা হয় স্থানীয়দের বিভিন্ন বিচারকার্য। দলীয় সব পরিকল্পনাও চলে তার অফিসে। যদিও সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে এমপির প্রতিনিধি পরিচয় দেওয়া এবং সরকারি সুযোগ সুবিধা বণ্টন করার কোনো বিধান নেই।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এমপির প্রতিনিধি নিয়োগ পেয়ে শিক্ষকতার চাইতে রাজনৈতিক বলয় তৈরির কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন সোহেল। বড় কিশোর গ্যাং তার এই বলয়ে রয়েছে। যারা এলাকায় নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িত।
স্থানীয় খাজুরিয়া বাজারের চা দোকানি ফারুক মিজি ও কাঠের ব্যবসায়ী নজির বলেন, আওয়ামী লীগ অফিস এখন আর খুলতে দেখি না। সোহেল মাস্টার যে অফিস দিয়েছে সেখানে লোকজন বসেন। প্রতিদিন বিকেলে এসে সোহেল ও তার অনুসারীরা এই অফিসে বসেন।
সোহেল ও তার অনুসারীরা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও মাদক কারবারে জড়িত বলে দাবি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইলিয়াছ বেগের। এবং সোহেলের মতো এমপির প্রতিনিধিদের কারণেই ইউনিয়ন আ.লীগের অফিস অকার্যকর হয়ে আছে বলে অভিযোগ তার।
তিনি বলেন, কোনো অনুষ্ঠান হলে আ.লীগের অফিস খোলা হয়। না হয় বন্ধই থাকে। আমরা দলীয় লোক হলেও আমাদের কোনো কাজ নাই। যারা আগে-পিছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর-যুবকদের নিয়ে ঘুরতে পারে তাদের সঙ্গে লোকজন ভিড়ছে। আমাদের অর্থ নেই, এই ধরনের কাজেও নেই। কারণ এসব ছেলেরা নেতাদের সঙ্গে ঘুরে পরে আবার মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িত হয়। এদের দায়িত্ব কে নেবে?
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির মতো এ বিষয়ে এমপির নিয়োগকৃত প্রতিনিধিদের দুষলেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাহেদ সরকার।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে দুইজন করে স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি আছে। এই নিয়ম বাংলাদেশের কোথাও নেই। আমার মতে এমপির পরিচয়ে তারা একটি নিজস্ব বলয় তৈরি করতে এই কাজটি করছেন। তারা নিজস্ব অফিসে বসে টিআর, কাবিখা ও বিভিন্ন ভাতা বণ্টন করেন। থানার মধ্যে এসেও তারা বসে থাকেন দালালি করতে। যেখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। এটি সাংগঠনিক কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না।
একই রকম বক্তব্য চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামের।
তার বক্তব্য, এমপির পরিচয় দিয়ে কিংবা প্রতিনিধি হিসেবে কার্যক্রমের কোনো সাংগঠনিক নিয়ম নেই। যদি কেউ করে থাকেন তাহলে এটি সংগঠনকে খাটো করা হবে। কোনো ব্যক্তির পছন্দে এই ধরনের প্রতিনিধি নিয়োগ হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি জনগণের মতামতে একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। সে ক্ষেত্রে কেন আবার আলাদা লোক নিয়োগ দিতে হবে। সব বিষয়ে সরাসরি কাজ হবে।
এদিকে সোহেল মাস্টারের কারণে গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মহিলা ইউপি সদস্য রোকেয়া বেগম।
তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের লোকজনের মধ্যে কোনো বিভেদ ছিল না। সোহেল মাস্টার এই অফিস দেয়ার পর বিভেদ দেখা দিয়েছে। আমরা বিভক্তি চাই না। আমরা সরকারের হয়ে সবাই মিলে সমাজের কাজ করতে চাই।
কথা হয় অভিযুক্ত সোহেল রানার সঙ্গে। আলাদা অফিস খোলার কারণ জানালেন তিনি। বললেন, আমি একজন শিক্ষক, আমার সমাজে সম্মান আছে। অফিস আমার না। এটি আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগীদের অফিস। কারণ বড়দের সঙ্গে এসব ছেলেরা গিয়ে বসতে পারে না। এই জন্য আলাদা অফিস তৈরি হয়েছে। আমার সঙ্গে তারা থাকে।
গুরুতর সব অভিযোগের বিষয়ে সোহেল রানা বলেন, বিচার কাজ আদালত করবেন। আমরা কেন করব! তবে এলাকার লোকজন কোনো সমস্যা নিয়ে বলে তা সমাধানের চেষ্টা করি। সব সমস্যার কথা নিয়ে তো এমপির কাছে যাওয়া যায় না। আর কিশোর গ্যাং, মাদক ও ইভটিজিংয়ের অভিযোগগুলো সঠিক না। আমাদের যারা প্রতিপক্ষ তারা এসব বলে। আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছি।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমানকে তার মোবাইল ফোনে কল করে জানানো হয় শিক্ষক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ-অনিয়মের বিষয়ে। তিনি তার প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন বলে জানানো হয়।
এ বিষয়ে এ সংসদ সদস্য বলেন, আমি তো তার (সোহেল) পরিচয়ে চলি না। সে আমার পরিচয়ে চলে। সে যদি কোনো অনিয়ম করে তার জবাব সে দেবে। সাংবাদিক হিসেবে আপনার যেটা করণীয় সেটি করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০২৩
এসএএইচ