বরিশাল: ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশালের নদ-নদীতে যেন চলছে চোর-পুলিশ খেলা। একদিকে অভিযানিক দলের টহল আরেক দিকে চলছে জেলেদের মাছ ধরা।
মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রকৃত জেলেরা ইলিশের প্রজনন নিয়ে খুবই সচেতন। আর তাই তারা নদীতে নামছেন না, তবে মৌসুমি জেলেদের দাপট রয়েছে নদীতে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরার দায়ে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে দুইশর বেশি ব্যক্তিকে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই মৌসুমি জেলে।
টানা কয়েকদিনের অভিযান শেষে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, মৌসুমি জেলেদের রোধ করার জন্য নানান উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে আত্ম সচেতনতা। আমাদের সবাইকে মা ইলিশ রক্ষায় সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, প্রথমে আমরা অভিযানে গিয়ে জেলেদের সতর্ক করছি। এরপর যারা নির্দেশ অমান্য করে তাদের জাল জব্দ করে ধ্বংস করছি। পাশাপাশি সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরে এনে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। তবে ইদানিং দেখা যায় অভিযানিক দলকে দেখতে পেয়ে নৌকা ফেলে অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের নৌকা বা বোটগুলোও এবারে জব্দ শুরু করেছি। তাও ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকছে না, নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তবে এতেই যে প্রতিকার হচ্ছে এমনটা নয়। বুধবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর দেড়টার দিকে ডিসি ঘাট থেকে কীর্তনখোলা নদীতে দ্বিতীয় দফার অভিযানে নামে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এ অভিযানিক দল নগরের ত্রিশ গোডাউন এলাকা অতিক্রম করতেই ছোট ছোট নৌকা নিয়ে দুই তীর থেকে কীর্তনখোলা নদীর মাঝে এসে জাল ফেলেন অসংখ্য জেলেরা। জাল ফেলেই নৌকা নিয়ে তীরে চলে যান, আবার অল্প সময়ের মাঝেই তা পুনরায় এসে তুলে ফেলেন।
কার্ডধারী জেলে মোহাম্মদ আলী জানান, যারা প্রকৃত জেলে তারা এ সময়টাতে মাছ ধরেন না। তবে যারা মাছ শিকারে এখন নদীতে নামছে তারা কেউই প্রকৃত জেলে নয়। ছোট-ছোট কারেন্ট জাল নিয়ে নদীতে মাছ শিকার করছে। কারণ সবাই জানে এসময়টাতে নদীতে মাছ থাকে।
তিনি বলেন, আর এসব জেলেদের অনেকেই নদীতে মাছ শিকার করতে সাহস পান মৎস্য বিভাগের সঙ্গে অভিযানের সময় চুক্তিতে নামা মাঝিদের কারণে। যেমন বরিশাল নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের খ্রিস্টান কলোনির রুহুল আমিন বিগত বহু বছর ধরে মৎস্য বিভাগের মাঝি হিসেবে কাজ করছেন। এবার তিনি মাঝি না হলেও রয়েছেন অভিযানিক দলের সঙ্গে। ফলে মৎস্য বিভাগ কখন কোন এলাকায় অভিযানে যাচ্ছে তা তিনি জানতে পারছেন। আর তার মাধ্যমেই অসাধু জেলে চক্র জেনে যাচ্ছে। ফলে অসাধুরা নদীতে চলমান অভিযানের ফাঁকেই মাছ শিকার করছে।
তিনি বলেন, রুহুলের মতো অনেকেই রয়েছেন যারা দীর্ঘ বছর ধরে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে মাঝি, সোর্স কিংবা শ্রমিক হিসেবে রয়েছেন। তারা কখনো নামমাত্র জাল ও জেলে ধরিয়ে দিচ্ছে আবার এর মধ্যে থেকেই লাভবান হচ্ছে। এক কথায় এরাই একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেছে।
বরিশালের স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিকেরই চরিত্র হরণ করে ফেলা হয়। ফোন করে অফিসে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়, তাই বাধ্য হয়ে আত্মসম্মানের কারণে চুপ থাকতে হয় তাদের। চলতি বছরে বরিশালে তিনটি নির্ধারিত লোকের বোট ও মাঝি দিয়ে অভিযানে যাচ্ছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বলা হচ্ছে সাংবাদিকরা টাকা খেয়েছে, নয়তো মাছ চেয়ে পায়নি বিধায় এমনটা করছে। কিন্তু বোটের শ্রমিক ও মাঝিরা প্রতিনিয়ত অবাধে জব্দ হওয়া মাছ নিয়ে যাচ্ছেন। বুধবার রাতেও রুবেল নামে এক শ্রমিকের ব্যাগে দেখা গেছে ইলিশ।
যদিও সব যে এমনটা হচ্ছে তাও নয়, এই সময়টাতে মাছ শিকারে বাধা দিলে মৎস্য বিভাগ বা অভিযানিক দলের ওপর প্রতিবছর হামলার ঘটনাও ঘটছে বরিশাল অঞ্চলে। যেমন চলতি মৌসুমের অভিযানে এ পর্যন্ত মেহেন্দিগঞ্জের তেঁতুলিয়া ও বানারীপাড়ার সন্ধ্যার শাখা নদীতে অভিযানিক দলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। শুধু অভিযানিক দলের ওপর হামলাই নয় জব্দ করা জাল, মাছ, নৌকা, ট্রলার সবকিছু ছিনিয়েও নেওয়া হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগ বলছে, অনেক জায়গাতেই জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীরাও মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত থাকছে। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ এসব জায়গাগুলো চিহ্নিত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ও টহল বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন।
তবে মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাসের মতে, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজসহ সবার মধ্যে আত্মসচেতনতা না বাড়লে মৌসুমি জেলেদের রোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যার যার নিজ অবস্থান থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে মৎস্য বিভাগকে সহযোগিতা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২৩
এমএস/আরএ