ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

খাদ্যশস্যে মহামারি এলে কী হবে, তা নিয়েও গবেষণায় ভারত বায়োটেক

হুসাইন আজাদ, নিউজ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০২৩
খাদ্যশস্যে মহামারি এলে কী হবে, তা নিয়েও গবেষণায় ভারত বায়োটেক

হায়দরাবাদ (তেলেঙ্গানা, ভারত) থেকে: শত বছর আগে যখন স্প্যানিশ ফ্লু গোটা বিশ্বকে পর্যদুস্ত করে ফেলেছিল, তখন স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাবিজ্ঞান এতটা এগোয়নি। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ওই ভাইরাস।

তারপর মাঝে আরও নানা রোগ-শোক এসেছে। এর মধ্যে আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস, মধ্যপ্রাচ্যে সার্স ভাইরাস এবং ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের মতো রোগের কথা উল্লেখ করা যায়।

তবে সেই স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মহাবিপর্যয় নিয়ে ২০২০ সালে বিশ্বে নেমে আসে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) অতিমারির প্রকোপ। প্রায় ৭০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়েছে এই ভাইরাস। সংক্রমিত করেছে ৭৭ কোটিরও বেশি মানুষকে। এই ভাইরাস সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। দেশে দেশে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানি সীমিত হয়ে পড়ে। যার জের এখনও টানতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে।

যদিও করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার করে আপাতত এই রোগের লাগাম টেনে ধরেছেন বিজ্ঞানীরা, কিন্তু এখানেই কি শেষ? মানুষের এই সাধারণ প্রশ্ন আছে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদেরও মাথায়। তারাও ভাবছেন, ভবিষ্যতে যদি এমন অন্য কোনো নতুন ভাইরাস বা অসুস্থতা মানবজাতিকে চেপে ধরে, তবে নিস্তার মিলবে কীসে?

এজন্য তারা আরও অগ্রবর্তী চিকিৎসা বা টিকার সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে আরও এক কদম এগিয়ে ভাবছেন ভারতের বহুমাত্রিক জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ভারত বায়োটেক’র বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গবেষণার পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের বিষয়টিও মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। উৎপাদিত কোনো খাদ্যের মাধ্যমে ভাইরাস বা ছোঁয়াচে রোগ ছড়ালে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে বা সেই পরিস্থিতি আগেই কীভাবে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে, তা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন তারা।

হায়দরাবাদ সফররত বাংলাদেশ সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৃহস্পতিবার মতবিনিময় করেন ‘ভারত বায়োটেক’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। হায়দরাবাদ মূল শহর থেকে সবুজ চাদরে ঢাকা জেনোম ভ্যালিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানে ‘ভারত বায়োটেক’র কার্যক্রমের বিস্তারিত তুলে ধরেন তারা। তারা জানান, মানুষ, পশু ও গাছপালার স্বাস্থ্য রক্ষায় নীরবে কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান।

এ সময় বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠানটির এক মুখপাত্র জানান, চিকুনগুনিয়া নামে মশাবাহিত যে রোগ বাংলাদেশ-ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে ভোগাচ্ছে, তার টিকা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে ভারত বায়োটেক। একই সঙ্গে গরুর লাম্ফি স্কিন ডিজিসের টিকার তৃতীয় ট্রায়াল শেষে অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করেছে বিজ্ঞানীদের। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভাইরাস প্রতিরোধে যেমন ভারত বায়োটেক গবেষণা করছে। তেমনি আলু বা যে কোনো খাদ্যপণ্যে যদি কোনো ভাইরাস বা রোগ বিপর্যয় নিয়ে আসে তাহলে সেটা কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, সেটার প্রস্তুতি নিয়েও কাজ করছেন ভারত বায়োটেকের গবেষকরা। করোনা মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মনোযোগী হয়েছেন, যেন খাদ্যপণ্যের কোনো রোগ সামলাতে কষ্ট কম হয়।

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপের প্রসঙ্গ টেনে জানতে চাওয়া হয়, এই জ্বরের কোনো ভ্যাকসিন আসবে কি না। জবাবে ভারত বায়োটেকের মুখপাত্র বলেন, ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশের বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। তবে এটি বেশ কঠিন কাজ, কারণ ডেঙ্গুর ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন হয়। এরপরও আশা করা যায়, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধেও কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে হয়তো। তবে এখন যে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তা আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ভারত বায়োটেকের যাত্রা ১৯৯৬ সালে। ড. কৃষ্ণ এম এলা ও তার স্ত্রী সুচিত্রা এলা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও বিলাসী জীবনের মোহ ছেড়ে দেশে ফিরে উদ্ভাবনী টিকা ও বায়ো-থেরাপিউটিকসে নিবেদিত এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়কার ভারত অর্থনীতি, গবেষণা ও বিজ্ঞানে এতদূর এগিয়ে না থাকলেও আজ সমৃদ্ধ এ জনপদে তার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে ইনটেলেকচুয়াল ক্যাপিটাল পাওয়ার হাউসে।

চিকিৎসার নানা ক্ষেত্রে অবদানের ধারাবাহিকতায় ভারত বায়োটেক করোনার কঠিন সময়ে আবির্ভূত হয় অন্যতম ত্রাণকর্তা রূপে। অক্সফোর্ড, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার মতো তারাও দ্রুততম সময়ে কো-ভ্যাক্সিন নামে টিকা আবিষ্কার করে আতঙ্কিত বিশ্বে স্বস্তি ফেরায়।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, করোনা মহামারি কেটে গেলেও এর কিছু ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় এখনও ভুগছে মানুষ। যারা মারাত্মক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্য এখনও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে করোনা। এ জন্য ভারত বায়োটেক তাদের আবিষ্কৃত কো-ভ্যাক্স নিয়েই বিশদ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।  

এরই ফল হিসেবে ভারত বায়োটেক জানাচ্ছে, এখন আর তাদের ভ্যাকসিনটি ইনজেকশন আকারে দিতে হবে না। নাকে ড্রপ দিলেই চলবে। এতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আরও কমে যাবে।

ওই মুখপাত্র দাবি করেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনার যেসব ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে কম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কো-ভ্যাক্সের, মাত্র ১৫ শতাংশ। যেখান অন্য ভ্যাকসিনগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রাণঘাতী অসংক্রামক রোগ ক্যানসার এবং ডায়াবেটিসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও গবেষণা চলছে। হয়তো শিগগির মানবজাতি এই দুই রোগের চিকিৎসায় কোনো সুখবর পাবে।

মুখপাত্র জানান, শুধু মানুষের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা নয়, ভারত বায়োটেক কাজ করছে গবাদি পশু-পাখি ও গাছ-গাছালির বিভিন্ন রোগের বিষয়েও। এছাড়া তারা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে তুলনামূলক কম মূল্যে টিকা দিচ্ছে।

ভারত বায়োটেকের ২১৫ পণ্য প্যাটেন্ট (স্বত্ব) আছে। তাদের পণ্যের উপকারভোগী বিশ্বের ১২৫টি দেশের মানুষ। এদের পণ্য উৎপাদন কারখানা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এবং কোরিয়ান খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন অনুমোদিত।

ভারত বায়োটেকের কাজের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. কৃষ্ণ এম এলার বার্তা, ‘আমরা ভারত বায়োটেক প্রতিযোগিতার মধ্যে লড়ছি না। বরং আমরা অঞ্চলভেদে গুরুত্ব না পাওয়া রোগের বিরুদ্ধে লড়ছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০২৩
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।