ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘জমি ভেঙে যাচ্ছে, কলিজা ফেটে যায়’

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৩
‘জমি ভেঙে যাচ্ছে, কলিজা ফেটে যায়’

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জ বাজারে পাশে মেঘনা নদীর তীরে বসবাস করেন ৬৫ বছরের বিবি রৌশন আরা ও তার ৮০ বছর বয়সী স্বামী নুর মোহাম্মদ। মেঘনা নদীর স্রোতে কেড়ে নিয়েছে তাদের জমির একটি অংশ এবং এ অঞ্চলের অনেকের বসতবাড়ি, ফসলি জমি, হাট বাজার, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু স্থাপনা বিলীন হয়েছে নদীতে।

 

রৌশন আরা বর্তমানে যে ঘরটিতে বসবাস করেন সেটি নদীর খুব কাছেই। বাশের বেড়া দিয়ে তৈরি ঝুঁপড়ি ঘরটিতে কোনোভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন রৌশন আরা ও তার বৃদ্ধ স্বামী নুর মোহাম্মদ। ৪০ বছর আগে ২০ শতাংশ জমিতে বসতি স্থাপন করে তারা। ঘরের পাশে থাকা কিছু জমিতে কৃষিকাজ করে কোনোমতে সংসার চলছিল তাদের। কিন্তু সেই জমি এখন গিলে খাচ্ছে রাক্ষসী মেঘনা। ইতোমধ্যে জমির একটি অংশ বিলীন হয়েছে মেঘনা নদীতে।

 বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) বিকেলে মেঘনা নদীর তীরে দেখা হয় রৌশন আরা ও নুর মোহাম্মদ দম্পতির সঙ্গে। রাক্ষুসে নদীর হিংস্রতার কাছে বৃদ্ধ এ দম্পতি খুবই অসহায়। মেঘনার ভাঙনের কথা তুলতেই কেঁদে উঠেন তারা।  

মেঘনার ভাঙনের কথা জানতে চাইলে কান্না জড়িত কণ্ঠে বৃদ্ধা রৌশন আরা বাংলানিউজকে বলেন, জমি ভেঙে যাচ্ছে, তাই কলিজা ফেটে যাচ্ছে। এ জমি ছাড়া আর কোথাও আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। জমির এক কোনে ঘর করে থাকি, বাকী জমিতে সবজি এবং সয়াবিন চাষ করি। নদীর তীরে হওয়ায় বিভিন্ন সময় জোয়ারের পানিতে সয়াবিন নষ্ট হয়ে যায়। ঘরেও পানি উঠে। অনেকটা যুদ্ধ করে যেন আমাদের বসবাস। কিন্তু মনে হয় আর এখানে টিকতে পারবো না আমরা। বসতি ভাঙতে শুরু করেছে। কোথায় যাবো আমরা। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার উপায় দেখছি না। আমাদের খবরও কেউ নেয় না।  

রৌশন আরার স্বামী বৃদ্ধ নুর মোহাম্মদ বলেন, আগেও দুইবার বসতি ভেঙেছে। এবারসহ তিনবার হবে। কয়েক বছর ধরে মেঘনার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি। যদিও এ বৃদ্ধ বয়সে এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তাই চোখের পানি ছেড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।  

তিনি আর বলেন, কমলনগর উপজেলার এখনকার মতিরহাট বাজারের দুই আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে আমাদের পূর্ব পুরুষের বাড়ি ছিল। ৬০ এর দশকে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে সব ঘরবাড়ি। এরপর মতির হাটের উত্তরে আমরা চলে আসি। ৭০ সালের দিকে সেখানেও মেঘনা হানা দেয়। বসতবাড়ি মেঘনায় বিলীন হয়ে যায়। পরে বেড়িবাঁধের পাশে কয়েক বছর ছিলাম। প্রায় ৪০ বছর আগে চলে আসি পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জ এলাকায়। ২০ শতাংশ জমি কিনে বসতি স্থাপন করি। তখন নদী আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে নদী আমাদের বসতির কাছে চলে এসেছে। এখন ফসলি জমি ভাঙা শুরু হয়েছে। ঘরটাও হয়ত ভাঙে যাবে। এরপর যে অন্য কোথাও যাব, সে অবস্থা নেই। আমার পাঁচ মেয়ে ও তিন ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। ছেলেরাও স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্যত্র থাকে। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুইজন এ ঝুঁপড়ি ঘরে থাকি। কৃষিকাজ করে দিনাতিপাত করি। কিন্তু জমি কিনে যে অন্য কোথাও বসতি গড়বো, সে সাধ্য আর আমার নেই।  

জান গেছে, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার উপকূলীয় ৩৭ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন রোধে দুই উপজেলার প্রায় ৩১ কিলোমিটার তীররক্ষা বাঁধের কাজ চলমান রয়েছে। তবে কমলনগরের পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।