নরসিংদী: দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার নরসিংদীর শেখেরচরের বাবুরহাটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে একশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
রোববার (২৯ অক্টোবর) দিনগত রাত ১১টার দিকে বাজারের সাটিং পট্টিতে এ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
আগুনে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও প্রায় একশ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বণিক সমিতির নেতারা জানিয়েছে, আগুনে যে পরিমাণ কাপড় পুড়েছে তার বাজার মূল্য আনুমানিক একশ কোটি টাকা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী, বণিক সমিতি ও ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি শুক্র থেকে রোববার পর্যন্ত দেশের বৃহৎ পাইকারি এই হাটের সাপ্তাহিক বেচাকেনা চলে। হাটের শেষ দিন রোববার রাত ১১টার দিকে সাটিং পট্টির গলিতে ষড়ঋতু থ্রি পিসের দোকানে প্রথমে আগুন দেখতে পায় বাজারের লোকজন। মুহূর্তের মধ্যে তা গলির অন্য দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে।
নরসিংদী ফায়ার সার্ভিস জানায়, রোববার রাত ১১টা ১৭ মিনিটে আগুন লাগার খবর পান তারা। এরপর ৭ মিনিটের মধ্যে প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কিন্তু বাজারের ভেতরের রাস্তা সরু থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। একই সঙ্গে নদী খননের পরে ক্ষতিগ্রস্ত সেতু মেরামত না করার কারণে বাজারে গাড়ি প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। ফলে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। পরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরের ১০টি ইউনিট যোগ দেয়।
এ সময় দোকান মালিকরা লোকজন নিয়ে মালামাল সরানোর চেষ্টা করে এবং আগুন নিভানোর কাজে নামেন। অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের চোখের সামনে দোকান পুড়তে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। রাত ২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
তবে এরই মধ্যে আগুনে পুড়ে যায় গলির ৯১টি ছোট বড় পাইকারি কাপড়ের দোকান। কাপড়ের মধ্যে আগুন থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তা নিভাতে কাজ করে। সোমবার দুপুর ১টায় আগুন নিভানো হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে।
দুপুরে সরেজমিনে বাবুরহাট গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ২ নম্বর সেতু দিয়ে সাটিং পট্টিতে প্রবেশ করতে হয়। হাটের মাঝখানেই সাটিং পট্টি। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে যাওয়া টিন ও কাপড় কাদা পানিতে মিশে একাকার। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও কাপড়ের গাঁট থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। সব কিছু হারিয়ে অনেক ব্যবসায়ী বিলাপ করছেন।
এ সময় কথা হয় এসএস ক্লথ স্টোরের মালিক সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাটে ঢোকার পথে ব্রিজ ভাঙা। তাই ফায়ার সার্ভিসের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে এতে আমাদের ক্ষতি বেশি হয়েছে। আমার দোকানের সব মাল পুড়ে গেছে। আমি এখন নিঃস্ব।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শাহজাহান মিয়া বলেন, রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে শুনি হাটে আগুন লাগছে। দৌড়ে এসে দেখি আমার দোকান জ্বলছে। তা দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন চারদিক শুধু অন্ধকার দেখছি।
জানতে চাইলে বাবুরহাট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, আমাদের হিসাব মতে ৯১টি দোকান পুড়ে গেছে। এতে প্রায় একশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অনেকেই ধার-দেনা করে ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। সরকার তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে তার এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।
নরসিংদী ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তদন্তে প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, বাবুরহাটে এর আগেও একাধিকবার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। হাটের সরু গলিতে অবৈধভাবে চৌকি ফেলার কারণে এবং ওপরে ছাউনি দেওয়ার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে বাজারে কোনো পানির সংরক্ষণাগার না থাকায় শুধুমাত্র পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়েছে। গুরুত্ব সহকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই হাটে আগুন ও ক্ষয়ক্ষতি দুটোই কমে আসবে।
রাতেই জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম তালেব হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
নরসিংদী জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম জানান, ইতোমধ্যে দুর্ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ ও সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চিত্রা শিকারীকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
খবর পেয়ে সোমবার বিকেলে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৩
আরএ