পাথরঘাটা (বরগুনা): ‘৩৫ বছর ধইরা সাগরে মাছ ধরি, মোর বয়সে চোখে এমন রুলিং (ঢেউ) দেহি নাই। এক ট্রলারে ১২ জন আছিলাম, ৪ জন ৯ ঘণ্টা সাগরে ভাইস্যা কূলে আইছি।
গভীর বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের জেলে নুরুজ্জামান মুন্সি (৬৫) ফিরে এসে সাগরের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) সকালে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে অন্যান্য ট্রলারের সঙ্গে রহিম খলিফার মালিকানা এফবি মায়ের দোয়া, রফিকের মালিকানা এফবি এলাহি ভরসা ও আনোয়ারের মালিকানা এফবি তামান্না। এর মধ্যে এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের ১২ জনের মধ্যে ৪ জেলে ৯ ঘণ্টা ভেসে ভাগ্যক্রমে বেঁচে কূলে ফিরে আসেন। একদিন পর এফবি এলাহি ভরসা ট্রলারসহ জেলেরা উদ্ধার হলেও ৬ দিনেও এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের অপর ৮ জেলে এবং এফবি তামান্না ট্রলারের ১৭ জন জেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ জেলেদের বাড়িতে চলছে আহাজারি। পরিবারের স্বজনরা জেলেদের অপেক্ষায় রয়েছেন।
এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের নিখোঁজ ৮ জেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যদের আহাজারি আর কান্না। কেউ ভাইয়ের জন্য, কেউ সন্তানের জন্য, কেউ স্বামীর জন্য কাঁদছেন। তাদের শোকে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তবে এমন চিত্র নতুন নয়, বছরের পর বছর, বংশ পরম্পরায় এমন শোক দেখায় অভ্যস্ত পাথরঘাটা উপকূলের মানুষ।
কথা হয় এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের ফিরে আসা ৬৫ বছরের জেলে নুরুজ্জামান মুন্সির সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে দেখেই আঁতকে ওঠেন; সাগরের ভয় এখনো কাটেনি তার। নুরুজ্জামান সেই বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘এমন রুলিং (ঢেউ) মোর বয়সে দেহি নাই। আমাগো ট্রলারের ১২ জন জেলে ছিল, হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে ঢেউ আর বাতাস শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে ট্রলারটি উল্টে যায়, প্রথমে আমি, মাসুম মিয়া, আজগর মিয়া ও রাজিব ট্রলার থাইক্যা লাইফ বয়া (জীবন রক্ষাকারী) নিয়া পানিতে লাফ দিই। কিছুক্ষণ পর ওই ট্রলারে থাকা ইউসুফ ও বেল্লাল লাফিয়ে পড়ে ভাসতে থাকলে কয়েক মিনিট পর তুফানে অন্য দিকে নিয়া যায়। এরপর আর ওই দুইজনের দেখা মেলেনি। ’
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমিসহ ৪ জেলে লাইফ বয়া (জীবন রক্ষাকারী) নিয়ে ভাসতে ভাসতে কয়েক ঘণ্টা পর শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে সঙ্গে থাকা জেলেদের কাছে দাবি দাওয়া ছাড়িয়ে মাফ চেয়ে নিয়ে বলি, মুই মইরা গেলে লাইফ বয়ার (জীবন রক্ষাকারী) লগে বাইন্দা রাখবা, একে একে যদি সবাই মইরা যাই তাইলে যেন সবার লাশ এক সঙ্গে থাহে। এক সময় কজনই দুর্বল হয়ে যাই। ৯ ঘণ্টা পর পটুয়াখালীর মহিপুরের একটি ট্রলারের জেলেরা দেখে আমাদের উদ্ধার করে। ’
এখনও যারা নিখোঁজ রয়েছেন তারা হলেন- এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের আবুল কালাম, মো. জাফর মিয়া, মজিবুর রহমান, ইউসুফ মিয়া, ছত্তার হাওলাদার, নাদিম, বেল্লাল ও ইয়াছিন মিয়া। এফবি তামান্না ট্রলারের আউয়াল বিশ্বাস, সফিকুল ইসলাম, মো. ফারুক, আব্দুল খালেক, মো. নান্টু মিয়া, মো. মাহতাব, সিদ্দিক মৃধা, কালু মিয়া, মো. মনির হোসেন, সহিদুল ইসলাম, মো. সুবাহান খাঁ, মো. ইউনুস সর্দার, মো. খলিল, আব্দুর রব, মো. আল আমিন, মো. লিটন, মো. কালাম।
নিখোঁজ ২টি ট্রলারে থাকা জেলেদের নামে ট্রলার মালিকের পক্ষ থেকে পাথরঘাটা থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তাদের বাড়ি। বরগুনা ও পাথরঘাটায়।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সাগরে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা আমাদের কাছে আসে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য কিন্তু আমাদের কাছে তাদের কাছে জবাব দেওয়ার মতো কোনো ভাষা নেই। ’
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত দুই ট্রলারের ২৫ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২৩
আরএ