মাদারীপুর: লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েও সন্তানদের মুক্ত করে আনতে পারেনি পরিবারগুলো। লিবিয়ার বন্দিশালায় আটকে রয়েছেন মাদারীপুরের পাঁচ তরুণ।
লিবিয়ায় বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন এই পাঁচ তরুণ হলেন - মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা এলাকার মান্নান ব্যাপারীর ছেলে সজীব ব্যাপারী (২৫), খালেক মৃধার ছেলে আরিফ মৃধা (২৮), ছিকু মৃধার ছেলে রনি মৃধা (১৮), কিনাই মৃধার ছেলে সজীব মৃধা (২০) এবং রুহুল খানের ছেলে রুবেল খান (২২)।
এই পাঁচ তরুণের পরিবারের দাবি, দেশ থেকে তাদের লিবিয়ায় পাঠানো, মুক্তিপণসহ এ পর্যন্ত প্রতিটি পরিবার ২৫ লাখ টাকা করে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। তবু ছেলেদের দেশে ফেরত পাঠায়নি চক্রটি।
সম্প্রতি র্যাবের হাতে মানবপাচারের অভিযোগে এক দালাল গ্রেপ্তার হলে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
ওই দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়েন মাদারীপুরের ৫ তরুণ। এরপর লিবিয়া নিয়ে তাদের বন্দি করে পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
তরুণদের পরিবার জানান, ইতালি যাওয়ার জন্য এক বছর আগে শরিয়তপুরের এক দালালের মাধ্যমে দেশ ছাড়ে তাদের ছেলে। ঢাকা থেকে প্রথমে দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পর্যটক হিসেবে কিছুদিন দুবাইয়ে থাকার পরে তাদের লিবিয়ার বেনগাজি শহরে নেওয়া হয়।
তারা জানান, একপর্যায়ে সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উপকূলে যাওয়ার পথে দালালেরা একটি বন্দিশালায় নিয়ে যায় তাদের। পরে মুক্তিপণ হিসেবে প্রত্যেকের জন্য ১০ লাখ টাকা করে দিলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। পরে দালালেরা ওই পাঁচ তরুণের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে অর্ধকোটি টাকা নিয়েছে। কিন্তু তাদের ছেড়ে দেয়নি, বরং টাকার জন্য ওই পাঁচ তরুণকে আবার নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
অভিযুক্ত দালালচক্রের একজন শরিয়তপুরের তুলাতলা এলাকার নুরুল ইসলাম খানের ছেলে কামরুজ্জামান খান (৪২)। যিনি এলাকায় টুলু দালাল নামে পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, কামরুজ্জামানের সঙ্গে তার ভাই রাশেদ খান ও স্ত্রী হাসিনা বেগমও তরুণদের ইতালিতে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। লিবিয়ায় বন্দি ওই পাঁচ তরুণের পরিবার এ পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা কামরুজ্জামান খানের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাঠিয়েছেন।
মাদারীপুর সদর উপজেলার পখিরা গ্রামের তানভীর মল্লিক (২১) নামের আরও এক তরুণকে ইতালিতে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাচারের অভিযোগে গত ১৬ নভেম্বর রাতে কামরুজ্জামান খান ওরফে টুলু খানকে (৪২) গ্রেপ্তার করে সদর থানায় হস্তান্তর করে র্যাব-৮।
কামরুজ্জামান খানকে আটকের খবর পেয়ে ওই পাঁচ তরুণের পরিবারের সদস্যেরা থানায় আসেন। পরে ওই পাঁচ তরুণের পক্ষে লিবিয়ায় বন্দি রনি মৃধার ভাই জাকির হোসেন মৃধা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
লিবিয়ায় দালালের হাতে বন্দি সজীব বেপারীর মা জাকিয়া বেগম বলেন, সজীবের বাবা মারা গেছেন। জমিজমা যা ছিল, সব বিক্রি করে ২০ লাখের বেশি টাকা দিয়েছি। তবুও আমার সন্তান ফেরিনি। আমার সন্তানকে মারধর করে। ওই ছবি দেখাইয়া টাকা নিতাছে তারা। ছাড়তাছে না!
লিবিয়ার বন্দিশালায় থাকা অপর তরুণ সজীব মৃধার বাবা কিনাই মৃধা বলেন, ‘টুলু দালাল এর আগে আমাগো গ্রামের দুইজনরে নিছে। পরে ওর কথায় বিশ্বাস কইরা আমার ছেলেরে দিছি। জায়গাজমি যা ছিল সব বিক্রি কইরা টাকা দিছি। আমার পোলারে ছাড়ে নাই। আমি দিনমজুরি কইরা সংসার চালাই। ’
লিবিয়ায় বন্দি রনির ভাই জাকির হোসেন মৃধা বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে একটা ঘরে আটকে নির্যাতন করছে দালালেরা। ভাইকে ছাড়াতে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকা চলে গেছে। আমাদের ভিটেমাটি সব বিক্রি করা শেষ। এখনো আমার ভাই ছাড়া পায়নি। আমার ভাইকে ওরা মারধর কইরা যা করছে, ওরে দেখলে আর চেহারা চেনা যায় না। দালালেরা এত দিন ভয় দেখাইছে, যদি থানা–পুলিশ করি, তাহলে ওরা রনিকে মেরে ফেলবে। ’
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এইচ এম সালাউদ্দিন বলেন, মানব পাচার আইনে হওয়া একটি মামলায় কামরুজ্জামান খানকে শরীয়তপুর থেকে র্যাবের সদস্যেরা গ্রেপ্তার করে থানায় হস্তান্তর করেছেন। পরে পাঁচখোলা থেকে কিছু লোক থানায় আসেন। তারাও জানান, তাদের ছেলেরাও এই দালালের খপ্পরে পড়ে এখন লিবিয়াতে বন্দি। তারা থানায় মামলার জন্য এজাহার দিলেও এই মামলা এখানে করার সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, মানব পাচারের অভিযোগে হওয়া মামলায় র্যাব কামরুজ্জামান খানকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে গত বৃহস্পতিবার হস্তান্তর করে। পরদিন শুক্রবার( ১৭ নভেম্বর) তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২৩
এসএএইচ