ঢাকা: সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে সাইবার সাপোর্ট টিমের জনবল বৃদ্ধিসহ শৈশব থেকেই সচেতনতা তৈরি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, তরুণদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সাইবার ক্রাইম মোকাবিলা করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, শুধু আইন দিয়ে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যতই আইন থাক আমাদের অ্যাকশনে যেতে হবে, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে, তা প্রতিহত করতে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মনিটরিং প্রয়োজন।
শনিবার (২ ডিসেম্বর) সিরডাপের এটিএম শামসুল হক মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘নারী ও কন্যার প্রতি সাইবার সহিংসতা: বাস্তবতা ও করণীয়’ বিষয়ে তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) শ্যাম সুন্দর শিকদার; বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাইবার ট্রাইবুনাল, ঢাকার বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) এ এম জুলফিকার হায়াত এবং বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (প্রটেকশন অ্যান্ড প্রটোকল) আমেনা বেগম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের অনেক ধরণের কার্যক্রম রয়েছে। সাইবার দুনিয়া একটি মুক্ত জায়গা যেখানে নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই দিতে হবে। ডিজিটাল লিটারেসি বৃদ্ধি করার কোন বিকল্প নেই। অভিভাবকদের বাচ্চাদের ইন্টারনেটের ব্যবহার মনিটরিং করতে হবে, তাদের ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে মেধা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সোশাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক এদেশে নেই। এরপরও বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিটিআরসির উদ্যোগে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ৩৫ হাজার আপত্তিকর কনটেন্ট ফেসবুক থেকে আলোচনার মাধ্যমে সরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যম নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাইবার ট্রাইবুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত বলেন, সাইবার স্পেসে বেশিরভাগ নারী ভিকটিম হয় প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার অভাবে এবং অপরাধ প্রমাণের জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ না থাকার কারনে অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়।
তিনি বলেন, বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহারের আগে পরিস্কার ধারণা নিতে হবে। ফেসবুক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। একটি নির্দিষ্ট বয়সের আগে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া থেকে অভিভাবকদের বিরত থাকতে হবে।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল আমেনা বেগম বলেন, মাঠ পর্যায়ে ৬৫৯টি পুলিশি থানা আছে। এসব থানার কেস তদন্ত কর্মকর্তাদের সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এতে ঢাকা সিটির চাইতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়া ঝুকিঁ বেশি। আন্ডার রিপোর্টিংয়ের জন্য এক্সপ্লয়টেশন বেশি হচ্ছে। পুলিশের সাইবার সাপোর্ট টিমে মাত্র ১৫-১৬ জন জনবল রয়েছে, যারা ৭০ হাজার কমপ্লেইন পেয়েছে। সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে সাইবার সাপোর্ট টিমের জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। সচেতনতা শিশুবেলা থেকেই তৈরি করতে হবে।
ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সকলকে সচেতন হতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, তরুণদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সাইবার ক্রাইম মোকাবিলা করা সম্ভব হবে তিনি জানান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ই-মেইলের মাধ্যমে হয়রানি, সাইবার বুলিয়িং, সাইবার স্টকিং, সাইবার পর্ণোগ্রাফি, সাইবার অপবাদ, মরফিং, ইমেইল স্পূফিং এবং নানা ধরনের সাইবার সহিংসতা ঘটছে। সাইবার অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে উপাদানগুলো মূলত কাজ করে সেগুলো হলো: ভিকটিমদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলীর সহজলভ্যতা, ব্যবহারকারীদের অজ্ঞতা এবং উদাসীনতা, ভিকটিমের দায়, একজনের ব্যক্তিগত তথ্য অন্য প্রোফাইলের নীচে ব্যবহার, এবং প্রযুক্তি বিকাশের সাথে আইনী পদক্ষেপের ফাঁক।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ৫৩ বছর ধরে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করতে যেয়ে দেখা গেছে নারীর অগ্রগতির পথে মূল বাধা নারীর প্রতি সহিংসতা। সহিংসতার ক্ষেত্রে নূতন নূতন ধরন যুক্ত হচ্ছে, বর্তমানে সাইবার সহিংসতার বেড়েছে। সাইবার ওয়ার্ল্ড একটা ইনফিনিট ওয়ার্ল্ড। এটা গ্লোবাল। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশকে নেতৃত্ব দানকারীদের সচেতনতার তৈরির কাজটা করতে হবে। আজকের আলোচনার মাধ্যমে সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধের যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা তৈরি হলো প্রত্যেকের কাজে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে সীমা মোসলেম বলেন, ডিজিটাল মাধ্যম সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা না থাকায় নারী ও কন্যারা সাইবার সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ফতোয়ার মাধ্যমে নানা রকম কুৎসা রচনা করার ফলে ডিজিটাল মাধ্যমের ইতিবাচক প্রয়োগ নিশ্চিত হচ্ছে না। অন্যদিকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে তা প্রতিহত করতে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মনিটরিং প্রয়োজন। পাশাপাশি বিনিয়োগ এর উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, সংগঠনের কর্মকর্তা, সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন প্ল্যাটফর্মের সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্তিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ