ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

চলনবিলে বাউত উৎসব, মাছ না পেয়ে হতাশ শিকারিরা

মুস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২৩
চলনবিলে বাউত উৎসব, মাছ না পেয়ে হতাশ শিকারিরা

পাবনা: পাবনার চলনবিলসহ স্থানীয় বিল গুলিতে শুরু হয়েছে বাউত উৎসব। এই উৎসবে মেতেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শৌখিন মৎস্য শিকারিরা।

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার রুহুল বিলে দলবেঁধে মাছ ধরার এই আয়োজনের নাম ‘বাউত উৎসব’। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই বাউত উৎসবে অংশ নেন নানা বয়সী হাজারো মানুষ। তবে এই বছরে বিলে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মাছের দেখা। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বাউতে আসা মৎস্য শিকারিরা।

তাদের অভিযোগ, অবৈধ চায়না জাল আর গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে মাছ ধরে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। তাই বাউত হারাচ্ছে তার উৎসবের আমেজ। একইসঙ্গে ধ্বংস করা হচ্ছে দেশি মাছের প্রজনন ক্ষেত্র।

জানা গেছে, জেলার চলনবিলের রুহুল বিল, ডিকশির বিল, রামের বিল, শ্যওলার বিলসহ জেলা চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদুপুর উপজেলার বিভিন্ন বিলে মাসব্যাপী চলে এই বাউত উৎসব। সূর্য ওঠার আগেই ভোর থেকে নিজেদের পরিবহন করে বাউত উৎসবে বিলে আসতে থাকে মানুষ। কারো হাতে পলো, কারো হাতে ঠেলা জাল আবার কারো হাতে ধর্মজাল। দল বেধে সারি সারি মানুষ ছুটে আসছে বিলপারে। কারণ একটাই উন্মুক্ত জলাশয়ে মনের আনন্দে মাছ ধরেন তারা। মাছ ধরা পরার সঙ্গে সঙ্গে মনের আনন্দে চিৎকার করে উঠবে পাইছিরে একটা বিশাল বোয়াল অথবা রুই কাতলা মাছ। এবারে বাউতের গল্পটা পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার চলনবিলের অংশ রুহুল বিলের।  

লোকজ রীতি আর সংস্কৃতির অংশ আমাদের বাউত উৎসব। বিলের জলে কলরবে মনের আনন্দে মাছ শিকার। দলবেঁধে মাছ ধরার এ আয়োজনে মৎস্য শিকারিদের ডাকা হয় বাউত বলে। তাদের ঘিরেই উৎসবের নামকরণ করা হয়। হাজার বছর ধরে গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে হয়ে আসছে বাউত উৎসব। বর্ষার শেষে বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ার সময়ে এই উৎসব হয়ে থাকে। বছরের নভেম্বরের মাসের শেষ থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর মাসের মাঝ সময় পর্যন্ত এই উৎসব চলে।

সপ্তাহের দুই দিন শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে পূর্বনির্ধারিত এলাকায় দলবেঁধে মাছ শিকারে নামে বাউতে আসা মাছ শিকারিরা। বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। কে মাছ পেলো বা না পেলো সেটি বড় বিষয় নয়। তাদের কাছে মাছ ধরতে আসাটাই আনন্দের। আর সেই আনন্দটা স্মৃতিময় হয়ে থাকে যদি সেখানে মাছের দেখা মেলে নিজের জালে।

তবে এবারে বাউতে মাছ ধরতে আসা মৎস্য শিকারিরা হতাশা হয়েছেন। হাজার হাজার টাকা খরচ করে রাতের ঘুম হারাম করে এই বাউতে এসে মাছ পাননি তারা।

মৎস্য শিকারিদের অভিযোগ, বিলে একদিকে বৈধ উপকরণে মাছ ধরছে বাউতে আসা শিকারিরা। অন্যদিকে প্রকাশ্যে অবৈধ চায়না ও কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরছে স্থানীয় জেলেরা। এদের দেখার কেউ নেই। অবৈধ চায়না ও কারেন্ট জাল দিয়ে দেশি মাছের প্রজনন ধ্বংস করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি এই বাউত আসা খবরে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলদের নিয়ন্ত্রণে বিল থেকেই বিল থেকে মাছ ছেঁকে ধরে নিয়েছেন। এমনকি বিষ ও গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে মাছের বংশ ধ্বংস করছেন তারা।
তবে এই বিষয়ে মৎস্য বিভাগ চরম উদাসীন। লোকবল সংকটের কারণে তারা মাছ ধরার অবৈধ উপকরণের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

মাছ ধরতে আসা শৌখিন মাছ শিকারি সুমন মণ্ডল বলেন, প্রতি বছর এই সময়ে বিল অঞ্চল গুলোতে বাউত উৎসবে মাছ শিকারে যান তারা। তবে এই বছরে পাবনার খালবিলে তেমন মাছ পাচ্ছেন না। চায়না জাল আর বিষদিয়ে বিলের মাছ মেরে ফেলার কারণে বলে মনে করছেন তারা। আগে বিলে প্রচুর দেশি মাছ ধরা পড়তো। আর এখন আগেরমতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল বাউতের আগেই মাছ ধরে নিচ্ছে। একইসঙ্গে তারা বিষ দিয়ে মাছের বংশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।  

মাছ শিকারি হাসান মোল্লা বলেন, বাউতে আসা মাছ শিকারিরা কোনো অবৈধ উপকরণ ব্যবহার করে না। কিন্তু স্থানীয় মাছ শিকারিরা প্রকাশ্যে চায়না ও কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরছে। পাশাপাশি তারা বিষ ও গ্যাট ট্যাবলেট দিয়ে মাছ ধরছে। এই কারণে আগামীতে বিলে দেশি মাছের চরম সংকট দেখা দেখা দেবে।

বাউত উৎস দেখতে আসা আহম্মেদ রানা বলেন, এতো সুন্দর ও আনন্দের উৎসব আর কোথাও পাওয়া যাবে না। যেখানে কাউকে কোনো অর্থ দিতে হয় না। হাজার হাজার মানুষ দলবেঁধে আসে এ উৎসবে। এটি গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ। এটিকে ধ্বংস না করে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সেটার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আরও কঠোর হতে হবে। একইসঙ্গে দেশের খাল, বিল, নদী নালাতে যারা অবৈধ উপকরণ দিয়ে মাছ শিকার করেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্থানীয় মৎস্য শিকারি বাধন সরকার বলেন, আগে বাউতে বিলের চার পাশের গ্রামের মানুষ ছোট বড় সবাই মিলে মাছ ধরতে যেতো। নানা প্রকারের ছোট বড় মাছ ধরতো তারা। তবে মাছের জন্য অভয়াশ্রম যেখানে থাকতো সেখানে তারা যেতেন না। আর এখন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মাছ ধরে উৎসবের পাশাপাশি দেশি মাছের বংশ ধ্বংস করছে একটি চক্র। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। তা-না হলে আগামী প্রজন্ম একদিকে যেমন বাউত উৎসব দেখতে পারবে না অন্যদিকে দেশি মাছ আহার থেকে বঞ্চিত হবেন সবাই।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, বাউত উৎসব গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অংশ। তবে নিয়ম মেনে সেটি কেউ পালন করছে না। তাই আমরা বাউত উৎসবকে নিরুৎসাহিত করছি। বিলে এক সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের মাছ ধরার কারণে জলজ জীববৈচিত্রসহ সব ধরনের মাছের ক্ষতি হয়। আর অবৈধ উপকরণের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে দেশি মাছ সংরক্ষণ বা অবৈধ মাছ শিকারিদের বিরুদ্ধে সেইভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। তাই সবাইকে বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ ও মৎস্য শিকারিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।