ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

শীতের তীব্রতায় পেটে টান লেগেছে খেটে খাওয়া মানুষের

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসফেন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২৩
শীতের তীব্রতায় পেটে টান লেগেছে খেটে খাওয়া মানুষের

ফেনী: শহরের রাজাঝির দিঘী পাড়ের কোর্ট মসজিদে ফজরের নামাজের পর ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে। শীতকালে দিঘীর পাড় ও রাস্তা থাকে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো।

হিমেল হাওয়ায় জড়সড় হয়ে থাকে প্রকৃতির চারপাশ। এমন বিরূপ আবহে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে খেজুর ও দোয়েল চত্বরে। কপালে চিন্তার ভাঁজ, মগজে জীবিকার চিন্তা।

নিজ এলাকায় ঠিকমতো কাজ পাওয়া যায় না। মজুরিও কম। তাই পরিবারের অভাব-অনটন মেটাতে কাজের সন্ধানে নিজের জেলা ছেড়ে ফেনী শহরে আসেন শ্রমিকেরা। শহরের ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্বর থেকে খেজুর গাছ গোলচত্বর পর্যন্ত প্রতিদিন জড়ো হন প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক। কাজ পেলে যা আয় হয়, তা দিয়েই বাসা ভাড়া ও সংসার চালান তারা। চলতি মাসে শীতের প্রকোপ শুরু হয়েছে বেশ। ঠাণ্ডার তীব্রতায় এসব খেটে খাওয়াদের পেটে টান লেগেছে। কাজ থাকলেও সহসা পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণেই দুশ্চিন্তা তাদের ঘিরে ধরেছে।

নুরুল আফসারের বাড়ি উত্তরের জনপদ দিনাজপুরে। ‘কামলা’ দিতে স্ত্রী-সন্তানসহ ফেনীতে এসেছেন। শহরেই বসবাস করেন। ছয় বছর ধরে নিয়মিত ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে শ্রমের হাটে আসেন। রোববার (১৭ ডিসেম্বর) খুব ভোরে দেখা হয় তার সঙ্গে। কথা বলে জানা যায়, তার মতো বহু মানুষ শহরের এ হাটে আসেন নিজেদের শ্রম বিক্রির জন্য।

কৃষিজমি পরিষ্কার, মাটি কাটা, নতুন সড়ক নির্মাণ, পরিত্যক্ত দালান, ব্রিজ ও কালভার্ট ভাঙা, ধান রোপণ, আলু, ভুট্টা, তরমুজ লাগানোসহ চুক্তিতে সব ধরনের কৃষিকাজ করেন। ছয়-আট মাস চলে তাদের কাজ। যে টাকা আয় হয়, সেটা দিয়ে বাসা ভাড়া ও সারা বছর সংসার চালান।

এমন হাজার খানেক নারী ও পুরুষ শ্রমিক ফেনীতে আসেন কাজের সন্ধানে। তাদের কারও বাড়ি উত্তরাঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুরে। কারও বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট, যশোর, নরসিংদী; কারও বাড়ি পাশের জেলা নোয়াখালী কিংবা লক্ষ্মীপুরে।

আফসারের সঙ্গে কথা বলে জিরো পয়েন্ট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শহরের দোয়েল চত্বর থেকে খেজুর চত্বর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের দুপাশে অন্তত হাজার খানেক শ্রমিক। কেউ সারিবদ্ধভাবে, আবার কেউ এলোমেলোভাবে বসে ও দাঁড়িয়ে আছেন। স্থানীয় কৃষকরা তাদের সঙ্গে কথা বলে দরদাম করে বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছেন। অনেককে দেখা যায় দিন চুক্তিতে কাঙ্ক্ষিত মূল্যে কাজ করতে দর-কষাকষি করছেন।

শহরতলীর কাজির বাগ থেকে শ্রমিক নিতে এসেছেন মো. রুবেল। তিনি বলেন, আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য কয়েকজন শ্রমিক দরকার। দিন প্রতি ৭০০-১০০০ টাকা পারিশ্রমিকে একেকজন শ্রমিক পাওয়া যায়। একসঙ্গে অনেক শ্রমিক পেতে শহরের শ্রমের হাটের ওপর ভরসা করেন ফেনীর গৃহস্থরা।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসী–অধ্যুষিত জেলা ফেনীর প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন কাজের জন্য প্রতিনিয়ত প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রতিবছর কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে আলু, ভুট্টা, সূর্যমুখী, শর্ষেসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শর্ষে ও ভুট্টার আবাদ হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবাদ ও ফসল তুলতে হয়। ফেনীতে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা অনেক কম। আর উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাজের অভাব। পেটের টানে তারা ফেনী আসেন। শীত এলে শ্রমিক পেতে একটু কষ্ট হয়। ঠাণ্ডার তীব্রতায় তাদের মজুরি নির্ধারণ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় অনেক সময়।

স্থানীয় লোকজন জানান, বছর দশেক আগে উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকেরা এ অঞ্চলে আসতে শুরু করে। প্রথম দিকে অল্প কিছুসংখ্যক শ্রমিক এখানে আসত। পরে সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ বছর আগের চেয়ে শ্রম বিক্রেতাদের সংখ্যা বেড়ে দুই থেকে তিন হাজার হয়ে যায়। ইদানীং কৃষিজমি ও কাজ কমতে শুরু করায় হাটে শ্রমিক আসা কমে গেছে। বর্তমানে সাতশ থেকে ৮০০ শ্রমিক প্রতিদিন কাজের খোঁজে আসে।

কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর অক্টোবর থেকে পরবর্তী বছরের মে মাস পর্যন্ত তাদের কাজের চাহিদা থাকে। এ সময় তারা জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে কম দামে অনেকে মিলে একসঙ্গে বাসা ভাড়া করে। আবার কেউ কেউ আশপাশের খুপরি, স্কুলের বারান্দা ও রেললাইনের পাশে অস্থায়ী বসতি করে থাকে। কাজ শেষ করে অনেকে ফেনী থেকে নিজ এলাকায় ফিরে যায়। কেউ কেউ আবার অন্য কাজে ফেনী থেকে চলে যায়।

কুড়িগ্রামের জসিম উদ্দিন জানান, সবকিছুর দাম বেশি। পেটের দায়ে কাজ করতে ফেনীতে এসেছেন। এখানেও কাজের চাহিদা কমে গেছে। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে তারা শ্রম বিক্রির হাটে এসে বসেন। শীতের তীব্রতা বেড়েছে। কাজ না থাকায় পেটে টান লেগেছে তাদের। নিদারুণ কষ্টে কাটছে তাদের জীবন।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২৩
এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।