মানিকগঞ্জ: পদ্মা নদীতে এই শীত মৌসুমে প্রায়ই কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার অন্যতম নৌপথ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া। কুয়াশায় নৌপথ ঢেকে গেলে দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধাও কুয়াশার কবলে পড়ে তীরের অতি কাছাকাছি এসেও পাড়ে ভিড়তে পারেনি। হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দে ফেরির তলদেশ থেকে পানি উঠতে শুরু করে। ৩০/৪০ মিনিটের সময়ের মধ্যেই নয়টি যানবাহন ও ২১ জন মানুষ নিয়ে পদ্মার ৪১ ফুট নিচে নিমজ্জিত হয়ে যায়। ডুবে যাওয়া ফেরিতে থাকা ২০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও নৌ-পুলিশ। কিন্তু দুর্ঘটনার চারদিন পার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছে রজনীগন্ধার সহকারী মাস্টার হুমায়ুন কবীর। ডুবে যাওয়া রজনীগন্ধা উদ্ধার ও তদন্ত অনুসন্ধান কমিটি কাজ করে যাচ্ছেন।
ফেরিঘাট সংশ্লিষ্ট ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার (১৭ জানুয়ারি) রাত ১টার দিকে দৌলতদিয়া ঘাট পয়েন্ট থেকে ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধা নয়টি যানবাহন নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। প্রতিটি ফেরি ক্ষেত্র বিশেষ ৩০/৪০ মিনিট সময় অতিবাহিত হয় নৌপথ পারাপারে। ওই (১৭ জানুয়ারি) রাত দেড়টার দিকে পদ্মা নদী কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায়। দুর্ঘটনা এড়াতে সাময়িক সময়ের জন্য ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কুয়াশায় দিক নির্দেশনা বাতির আলো অস্পষ্ট হয়ে আসায় পাটুরিয়া ফেরিঘাট পয়েন্টের ৫ নম্বর পন্টুনের মাত্র তিনশ মিটার দূরেই অনুমান মধ্য রাত (১৭ জানুয়ারি) আড়াইটার দিকে নোঙর করে রজনীগন্ধা। নোঙর করা ফেরি থেকে বিকট শব্দের সৃষ্টি হয় সকাল সোয়া ৭টার দিকে এবং পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। ফেরিতে থাকা নয়টি যানবাহন একদিকে কাত হয়ে গেলে ফেরিটিও একইভাবে কাত হয়ে বেশ কিছু সময় নিয়েই ডুবে যায় পদ্মায়।
জানা যায়, ডুবে যাওয়া ফেরি উদ্ধার কাজের প্রথম দিনে জাহাজ হামজা বিআইডব্লিউটিএর ট্রাক-বোর্ডের সহায়তায় ভেসে যাওয়া দুটি ট্রাক উদ্ধার করে। পরে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে একটি ট্রাক উদ্ধার করে রুস্তম। সর্বশেষ গত শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুর সোয়া ২টার দিকে ডুবে থাকা রজনীগন্ধা উত্তোলনের কাজে যুক্ত হয় প্রত্যয়।
শনিবার (২০ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফেরি উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও হামজা-রুস্তম অলস সময় অতিবাহিত করে, তবে ডুবে থাকা রজনীগন্ধার নিচ দিয়ে লিফটিং পদ্ধতিতে সলিং ওয়্যার টানার কাজ করছে প্রত্যয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-বাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সদস্যরা সলিংয়ের কাজ করেছে। সফলভাবে একটি সলিংয়ের ওয়্যারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বাকি একটি প্রক্রিয়াধীন। প্রত্যয়ের কাজে সহায়তার জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ঝিনাই-১ আসছে। এই জাহাজটি এসে পৌঁছালেই ডুবে থাকা ফেরিটি উত্তোলনের মূল কাজে যাবে বিআইডব্লিউটিএ।
ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধা থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া ট্রাক চালক নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা রাতের দিকেই দৌলতদিয়া ঘাট থেকে পাটুরিয়া ঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। যেখানে ফেরিটি নোঙর করা ছিল এখানে হয়ত রাত আড়াইটার দিকে আসছিলাম। এর মাঝে একটি ঝাকুনি অনুভব করেছি তারপর প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গাড়ি থেকে নিচে নেমে দেখি হাঁটু পানি। পরে আমি সবাইকে ডেকে ফেরির ওপরে নিয়ে আসি তারপর ধীরে ধীরে ফেরির ভেতর পানি বাড়তে থাকে এবং পুরো ফেরিটি একটু সময় পানির নিচে ডুবে যায়। আমাদের চিৎকারে আশপাশে থাকা ট্রলারের চালকরা এগিয়ে আসে পরে আমরা তাদের ট্রলারে চড়ে জীবন বাঁচাই।
নাম পরিচয় প্রকাশ না করার মর্মে আরও এক ট্রাক চালক বলেন, রাত অনুমান ১টার দিকে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসে ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধা। পদ্মা নদীর মাঝে ছোট একটি ডুবোচরে আটকে যায় ফেরিটি কিন্তু অল্প সময়ের ভেতর সেখান থেকে ছেড়ে পুনরায় ফেরি চলতে শুরু করে। কুয়াশার কারণে ফেরির আলো অস্পষ্ট হয়ে এলে নোঙর করে রাখা হয়। পরে সকাল সোয়া ৭টার দিকে ফেরির নিচ থেকে বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়। ট্রাকের ভেতর থেকে নেমে দেখি ফেরিতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পানি প্রবেশ করতে করতে একটি সময় পুরো ফেরিটি পদ্মা নদীতে ডুবে যায়।
নিখোঁজ হুমায়ুন কবীরের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, গত বুধবার (১৭ জানুয়ারি) সকালে ফেরিটি ডুবে যাওয়ার সময় সবাইকে ডেকে তোলেন ভাই। সবাই জীবিত উদ্ধার হলেও আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমার পরিবারের সদস্যদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। মা, ভাইয়ের স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ছিল তার পারিবারিক জীবন। সবাই তার জন্য চিন্তায় আছি। আমি সরকার প্রধানের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি আমার ভাতিজি ও ভাতিজার ভবিষ্যতের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় আনতে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতিয়া ঘাটের বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক সালাউদ্দিন বলেন, রজনীগন্ধা নামের যে ইউটিলিটি ফেরি পাটুরিয়া ৫ নম্বর পন্টুনের খুব কাছে ডুবে গেছে, ওই ফেরিটি গত বুধবার (১৭ জানুয়ারি) রাত ১টার সময় নয়টি যানবাহন ও মানুষ নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে যায়। কুয়াশায় ফেরি বন্ধ কখন হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে অন্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
অপরদিকে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের বাণিজ্য বিভাগের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, রাত দেড়টার দিকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় কারণ পদ্মা নদীর পুরো নৌপথ কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায়। ক্ষেত্র বিশেষ এক-একটি ফেরি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ পারাপারে ৩০/৪০ মিনিট সময় লাগে। আমাদেরও বুঝতে সমস্যা হচ্ছে রাত ১টায় ছেড়ে আসা ফেরি কীভাবে রাত আড়াইটার দিকে পাটুরিয়া ৫ নম্বর পন্টুনের কাছে নোঙর করে।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা জেসমিন বলেন, আপনারা জানেন কীভাবে ডুবলো ফেরিটি। এ দুর্ঘটনায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই আসছি, দেখছি। ডুবে যাওয়া ফেরি উদ্ধারে ক্যাবলের কাজ চলমান আছে এবং ফেরিটি কীভাবে আছে সেই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফেরি উদ্ধারের পর বাকি বিষয়ে আপনাদের জানাতে পারবো। তদন্তের জন্য আমরা স্টেপ বাই স্টেপ এগুচ্ছি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, আমরা কাজ করছি, আজকেই পরিকল্পনা ছিল বাতাস দিয়ে কিছু করা যায় কিনা ‘এরই মধ্যে পারসেস রিং পরানো হয়েছে’ আরও একটা পরাতে পারবো। আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঝিনাই-১ নামের একটি বড় জাহাজ নিয়ে আসতেছি, আশা করছি দ্রুতই পৌঁছাবে। হামজা-রুস্তম এত বড় লোড নিতে পারবে না বলে তারা আজ কোনো কাজ করছে না। তবে বড় জাহাজ ঝিনাই-১ এলে সম্মিলিতভাবে ডুবে থাকা ফেরি রজনীগন্ধা তোলার কাজ করবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৪
আরএ