নরসিংদী: সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসিমাখা মুখের এক ফুলের নাম সূর্যমুখী। আর তা যদি হয় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে হাজার হাজার এ ফুলের সমাহার।
এই ফুলের বাগানে অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ভিড় করছে প্রতিদিন। মানুষ যেন ফুলের রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারে সেজন্য বাগানটি সাজানো হয়েছে নান্দনিক সাজে। রয়েছে পিটুনি ফুলের রাজ্য আপন রেস্টুরেন্টে বসে প্রিয়জনের সঙ্গে খাবার খাওয়ার সুযোগ। তবে বাগানের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনাকে গুনতে হবে মাত্র ৩০ টাকা।
জানা গেছে, নরসিংদী সদরের নাগরিয়াকান্দি এলাকায় ১৫ বিঘা জমির ওপর তৌহিদুল ইসলাম মাসুম ও মাহবুবুর রহমান সূর্যমুখী ফুলের বাগান গড়ে তুলেছেন। এবার বারি ২, বারি-৩ ও হাইসান জাতের সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। ১৫ বিঘা জমি চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ছয় লাখ টাকা। তবে মাসুম ও মাহবুবুরের সূর্যমুখী ফুলের বাগানটি তার অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দিনকে দিন মানুষের কাছে জনপ্রিয় স্থান হয়ে উঠছে।
প্রতিদিন সূর্যমুখী ফুলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে এসেছে। কেউ বা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। এবং অনেকে ফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই মাঝে ছোট মৌমাছিগুলোও থেমে নেই, ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত তারা। সকালে থেকে বিকেল পর্যন্ত জায়গাটি নানা বয়েসের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়।
সরেজমিনে সূর্যমুখী ফুলের বাগানে ঘুরে দেখা যায়, নরসিংদীর শেখ হাসিনা সেতু সংলগ্ন মেঘনা তীরবর্তী বিশাল এলাকা জুড়ে বাগানটি গড়ে উঠেছে। প্রধান সড়ক থেকে নামলেই দৃষ্টিনন্দন গেটের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের স্বাগত জানানো হয়েছে। বাগানে প্রবেশ করতে হলে টিকিট কাউন্টার থেকে ৩০ টাকার টিকিট কিনে নিতে হবে। বাগানে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে নান্দনিক গেট, সেলফি বুথ ও ওয়াচ টাওয়ারের। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন রঙের ঝুলন্ত ছাতার সমাহার, যার নাম দেওয়া হয়েছে ছাতা নগরী। যার মাধ্যমে বাগানের সৌন্দর্য আর দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেঘনার তীরে সূর্যমুখী বাগানে কেউ এসেছে প্রিয়জনের সঙ্গে, আবার কেউ পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছে। প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সবাইকে মোবাইল ফোনের ছবির মাধ্যমে নিজেদের বন্দী করছেন।
নরসিংদীর শিবপুর থেকে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছে নাদিম হাসান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পরীক্ষার কারণে অনেকদিন কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হয়নি। পরীক্ষা শেষ হওয়ায় তাই বন্ধুদের নিয়ে সূর্যমুখী বাগানে ঘুরতে এসেছি। মেঘনা নদী আর সূর্যমুখী বাগানের অপরূপ দৃশ্য একসঙ্গে উপভোগ করতে ভালোই লাগছে।
পাশেই সূর্যমুখী ফুলের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন নরসিংদী মডেল কলেজের ছাত্র সাব্বির হোসেন। তিনি বলেন, আমরা শহরে থাকার কারণে প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। শুধু সূর্যমুখী বাগান এত সুন্দর হবে এখানে না আসলে জানতাম না। আর বাগানটিকে দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। যার কারণে সময়টা ভালোই কেটেছে।
এদিকে, ফেসবুকের টাইমলাইনে ভাসছে সূর্যমুখীর হলুদের আভায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া অপার মুগ্ধতার ছবি। সবাই সূর্যমুখী ফুলের রাজ্যের সৌন্দর্যে কথা জানিয়ে ঘুরাঘুরির ছবি পোস্ট করছে। যার ফলে অন্যরা ও বাগানে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করছে। বাগানে কথা হয় নরসিংদীর পশ্চিম কান্দাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রিতা আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, ফেসবুকে বান্ধবীদের সূর্যমুখী বাগানের ঘোরার ছবি দেখে আমি ও ঘুরতে এসেছি। ছবিতে যা দেখেছি বাস্তবে বাগান তার চেয়েও বেশি সুন্দর। বাগানের পাশে পিটুনি ফুলের আপন আমার কাছে বেশি সুন্দর লেগেছে। পাশে ছাতা নগরী ভিনদেশি আবহ সৃষ্টি করছে। মেঘনার মৃদু বাতাসের সঙ্গে সূর্যমুখী বাগান আমাদের মনকে বিমোহিত করেছে।
তবে দর্শনার্থীরা বলছেন নরসিংদী শহরে চিত্তবিনোদনের খুবই অভাব। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা চিত্তবিনোদনের অভাবে মোবাইল ও কম্পিউটারে ইন্টারনেট আর গেম খেলার দিকে ঝুঁকছে। এর আগে শহরবাসী নিজেদের ছুটির দিনে নরসিংদী শেখ হাসিনা সেতুতে ঘুরাঘুরি করে সময় কাটাত। এখন সূর্যমুখী বাগানের কথা জানতে পেরে সবাই বাগানে ভিড় জমাচ্ছেন।
শহরের থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন মুক্তা বেগম। তিনি বলেন, বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরাঘুরি করার মতো বিনোদন কেন্দ্রের খুবই অভাব। আর তারা ঘরে বসে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাদের একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য বাগানে ঘুরতে নিয়ে এসেছি।
সূর্যমুখী বাগানে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। দর্শনার্থীদের কাছে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ টিকিট বিক্রি করে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করে বাগান মালিক। তবে ছুটির দিন আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়। বাগানটিকে দর্শনার্থীদের জন্য ১৫ প্রকারের পিটুনি ফুলের সমাহারে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে আপন রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে। যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে সূর্যমুখীর পাশাপাশি আপন ও দর্শনার্থীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে তার সৌন্দর্যের কারণে। বাগানটি পরিচর্যা ও দেখাশোনা করার জন্য প্রায় ২৫ জন কর্মচারী রয়েছে।
সূর্যমুখী বাগানের উদ্যোক্তা তৌহিদুল ইসলাম মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, সূর্যমুখী বীজ থেকে তেল উৎপাদনের উদ্দেশে বাগান করা হলেও দর্শনার্থীদের আগ্রহের কারণে বাগানটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে রূপ দেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বাগানটিতে নান্দনিক গেট, সেলফি বুথ ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। এবার পিটুনি ফুলের সমাহারে আপন রেস্টুরেন্ট সংযোজন করা হয়েছে। মানুষ এখানে ঘুরার পাশাপাশি বিয়ের ফটো শ্যুট ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। ভবিষ্যতে আপনের সঙ্গে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে দর্শনার্থীরা রাতে নদীর তীরে বসে সূর্যমূখী বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাহবুবুর রশীদ বলেন, চলতি বছর জেলার ছয়টি উপজেলায় প্রায় ১৮ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়েছে। আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও বীজ দিয়ে সাহায্য করে থাকি। বর্তমানে সূর্যমুখী তেলের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষের জানার কারণে চাষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সূর্যমুখী বাগানে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকায় অনেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য চাষ করছে। তবে দর্শনার্থীদের কৃষকের ফুল ও বাগান নষ্ট না করে বাগানের সৌন্দর্য উপভোগের অনুরোধ করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
এসএম