ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একাত্তরের ২৭ মার্চ কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন কবি কাজী রোজি। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৪র্থ সাক্ষী কাজী রোজি ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবি মেহেরুন্নেসার বান্ধবী।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে দুই ভাই ও মাকেসহ কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করে সাক্ষ্য দেন কাজী রোজি। তাকে সাক্ষ্য দানে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আরী।
মেহেরুন্নেসা হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে কবি কাজী রোজি জানান, ২৭ মার্চ কাদের মোল্লার নেতৃত্বে অবাঙালি বিহারি এবং পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে গিয়ে তাদের হত্যা করে। জবাই করে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করা হয়। মেহেরুন্নেসাকে জবাই করে হত্যার পর তার মাথা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
সাক্ষ্যদানের পর কাজী রোজিকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক। জেরা আগামী বৃহস্পতিবার ২৬ জুলাই পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেছেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
কবি কাজী রোজী তার সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার দু’দিন পর তিনি এ ঘটনা জানতে পারেন। স্বাধীনতার পর গুলজার নামের একজন বাঙালি এবং আরেকজন অবাঙালির কাছ থেকে তিনি কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার পুরো বিবরণ শোনেন। কাদের মোল্লা ঘরের ভেতর ঢুকেছিলেন কিনা, তা তিনি বলতে পারেন না, তবে তার নেতৃত্বেই এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে নিশ্চিত করেন কাজী রোজি।
তিনি বলেন, “কবি মেহেরুন্নেসা ছিলেন আমার বান্ধবী ও প্রতিবেশী। ১৯৭১ সালে আমি থাকতাম মিরপুরের সেকশন-৬ এর ব্লকের ৪ নম্বর অ্যাভিনিউয়ের ৮ নম্বর বাড়িতে। আর আমার বান্ধবী মেহেরুন্নেসা সম্ভত ডি ব্লকে থাকতেন। বাসার নাম্বার এ মুহূর্তে মনে নেই। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ঢাকার মিরপুরে একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলাম। আমি এবং মেহেরুন্নেসা ছিলাম সেই অ্যাকশন কমিটির নারী সদস্য। ”
প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে সাক্ষী বলেন, “২৭ মার্চ সকাল ১১টার দিকে মেহেরুন্নেসার বাড়িতে ঢোকে কাদের মোল্লার সহযোগীরা, যাদের মাথায় সাদা অথবা লাল পট্টি বাধা ছিল। মেহের যখন দেখলেন, ওরা তাদের মারতে এসেছে, তখন কোরআন শরীফ বুকে চেপে বাচঁতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই চারজনকেই তারা জবাই করেছিল। মেহেরকে মেরে গলাটা কেটে ফ্যানের সঙ্গে মাথার চুলে বেধে মাথাটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ’’
তিনি বলেন, ‘‘এ ঘটনা শুনে কষ্ট পাই। মেহেরুন্নেসার অতৃপ্ত আত্নার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, আমি তার জন্য কিছু করতে পারিনি।
‘‘স্বাধীনতার পরে আমি মেহেরম্নন্নেসার বাসায় যেতে চেয়েছিলাম। তবে আমি জানতাম যে, সেই বাসায় অন্য কেউ বাস করে। ’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘গুলজার এবং অন্য একজন অবাঙালি যার মুখে ঘটনাগুলো শুনেছিলাম, তারা এখন এ দেশে নেই। ’’
মাহাবুবুল আলম চৌধুরীর কবিতার চরণ তুলে ধরে কাজী রোজি বলেন, ‘‘আমি কাদতে আসিনি আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। আমি সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। আমি বিচার দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না। আমার ভেতর কোনো রাগ নেই। শুধুই ঘৃণা। ’’
প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী কবি রোজির কাছে জানতে চান, ‘‘১৯৭০ সাল সম্পর্কে আপনি কি জানেন?’’ এ প্রশ্নের জবাবে কবি কাজী রোজি বলেন, “১৯৭০ সালের কথা আমার মনে আছে। ৭০ সালের নির্বাচনে মিরপুর নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। ”
তিনি বলেন, “সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘ নামে একটি ছাত্র সংগঠন ছিল। ওই সংগঠনের বলতে গেলে প্রধান ছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লা। তার নেতৃত্বে অবাঙালি বিহারিরা তার অনুচর হিসেবে ছিলেন। তখন তারা দাঁড়িপাল্লার পক্ষেই কাজ করেছেন। ”
‘‘অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট জহিরুল। আমরা তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেই। ’’
সাক্ষী বলেন, “কবি মেহেরুন্নেসা প্রায়ই আমার সঙ্গে থাকতেন। কারণ, আমরা একটা ঐক্য কমিটি করেছিলাম। আমি ছিলাম ওই কমিটির প্রেসিডেন্ট আর মেরহেরুন্নেসাসহ তার সঙ্গে আরো অনেকে সদস্য ছিলেন। মিরপুরের বাঙালিরা অবাঙালিদের হাতে ভীষণভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতেন। এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা একটি অ্যাকশন কমিটিও গঠন করেছিলাম। ’’
‘‘মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে আমরা মিটিং করতাম, যেন বাঙালিরা এক সঙ্গে থাকতে পারি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলাম। এই ভাষণটিই ছিল আমাদের জন্য স্স্বাধীনতার ডাক। মিরপুরের বাঙালিরা এটা মানতেন। কিন্তু অবাঙালিরা বৈরি মনোভাব পোষণ করতেন। ’’
কবি কাজী রোজি বলেন, “আমরা তখনকার অবস্থা বুঝতে পেরে সমাবেশ করতে থাকি। এভাবেই ২৫ মার্চ চলে আসে। ২৫ মার্চ সকালে একটা মিটিং করেছিলাম। সেই মিটিংয়েই বুঝতে পারি, একট কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরে জানতে পারলাম যে, আমার বাসায় রেইড এবং মেহেরুন্নেসার বাসায় হাঙ্গামা হবে। ওই রাতেই আমাদের দু’জনের বাড়িতেই পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় অবাঙালিরা আক্রমণ চালাবে বলেও খবর পাই। এ খবর পেয়েই চিন্তা করলাম, আজকেই বাসা থেকে চলে যাবো। ”
সাক্ষী বলেন, ‘‘এ খবর আমি লোক মারফত কবি মেহেরুন্নেসাকে জানিয়ে দেই। বলেছিলাম, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরাও অন্য কোথাও চলে যাও। কিন্তু কবি মেহেরুন্নেসা তার ভাইকে আমার কাছে পাঠান। তিনি বলে দেন, আমাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। আমরা কোথায় যাবো?’’
তিনি বলেন, “মেহেরুন্নেসার ভাইকে বললাম, তুমি বাসায় গিয়ে তোমার মা এবং বোনকে বোঝাও যে, এখন বাড়ি থেকে চলে যাওয়া প্রয়োজন। এর পরে আমি আর মিরপুরে থাকলাম না। কিন্তু তারা রয়ে গেল। ”
উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৭ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৩য় সাক্ষী হিসেবে তার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপন সাক্ষ্য (ক্যামেরা ট্রায়াল) দেন। ওই দিন এবং পরদিন তার জেরা সম্পন্ন করেন আসামিপক্ষ। আরো একজন নারী সাক্ষীরও রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোপন সাক্ষ্য (ক্যামেরা ট্রায়াল) দেওয়ার কথা রয়েছে খুব শিগগিরই।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে কাদের মোল্লার হাতে ওই দু’জন নারী সাক্ষী নিজেরা অথবা তাদের স্বজনেরা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তারা তাদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে সাক্ষ্য দিতে আবেদন জানান। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল-২ তাদের ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে সাক্ষ্য ও জেরা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এই প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে-২ রুদ্ধদ্বার সাক্ষ্যগ্রহণ (ক্যামেরা ট্রায়াল) অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ট্রাইব্যুনালে এরও আগে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা--- প্রথম সাক্ষী মোজাফফর আহমেদ খান ও দ্বিতীয় সাক্ষী শহিদুল হক মামা। আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।
গত ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরানীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও খাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত বছরের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৬ এপ্রিল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করার পর গ্রেফতারকৃত বিএনপি-জামায়াতের ৯ নেতার মধ্যে মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বর্তমানে কাদের মোল্লা ছাড়াও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। তারা ছাড়াও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এছাড়া গ্রেফতারকৃত জামায়াতের কর্মপরিষদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গত ৫ জুলাই তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে এবং আগামী ১২ আগস্ট তদন্ত সংস্থার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের কথা রয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতের সাবেক রোকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তিনি পালিয়ে দেশত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তদন্ত সংস্থা অগ্রগতি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি নেতা আবদুল আলীম শর্তসাপেক্ষে জামিনে থাকলেও অন্যরা কারাগারে আটক আছেন। তবে অসুস্থতার কারণে গোলাম আযম বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও সাঈদী বারডেম হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩২ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১২
জেএ/সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর[email protected]