ঢাকা: ভালো চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়। দেখানো হয় উন্নত জীবন-জীবিকার আশা।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ৫৫৭ জন বাংলাদেশির যাত্রা, গন্তব্য, অর্থ, নিপীড়ন, উদ্ধার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ৫০ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
গত এক দশক ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া লোকজনের মধ্যে যেসব দেশের নাগিরকরা রয়েছেন, বাংলাদেশ সেই তালিকার শীর্ষ দশে থাকছে। প্রায়ই এভাবে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত নানা দেশের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গিয়েছেন। এভাবে যেতে গিয়ে প্রায় ২২ হাজার মানুষ সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পযর্ন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন।
এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে এভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে নয় বাংলাদেশি প্রাণ হারান। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২৬ বাংলাদেশিকে। এরপরও এমন যাত্রা থামছে না। গতকাল বৃহস্পতিবারও (২২ ফেব্রুয়ারি) লিবিয়া থেকে ১৪৪ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন।
গবেষণার ফলাফল
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোক সবচেয়ে বেশি। এদের বেশিরভাগেরই বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্র্যাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এলাকায়।
লিবিয়াফেরত ৫৫৭ বাংলাদেশির তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৬০ শতাংশকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরি বা কোনো কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন।
যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গিয়েছেন।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন। বন্দিদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে ছিলেন। এদের ৭৯ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার। এ ছাড়া লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনো তিনবেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছেন।
এভাবে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য অর্থ কোথায় পেয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫৬ শতাংশ বলেছেন, তারা নিজেরাই এই টাকা যোগাড় করেছেন। ২৩ শতাংশ বলেছেন তারা পরিবারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছেন।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) বলেন, বাংলাদেশের সব জেলার লোক কিন্তু এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে না। মূলত শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন এভাবে ইউরোপে যায়। আমাদের গবেষণায় এটি উঠে এসেছে যে, দালালরা এসব এলাকার অভিভাবক ও তরুণদের ভালো চাকরি আর ইউরোপের প্রলোভন দেখাচ্ছে, যেটি বাস্তব নয়। কাজেই সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সবার আগে সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানবপাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে অর্থের লেনদেন খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি যে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র রয়েছে লিবিয়া বা অন্য দেশে, তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে। লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান এলাকার স্থিতিশীলতা জরুরি। নয়তো সেখানকার মানুষজন জীবন বাঁচাতে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করবে আর সেই সুযোগে পাচারকারীরা বাংলাদেশের মতো আরও অনেক দেশের নাগরিককে সেখানে যুক্ত করবে। কাজেই সম্মিলিতভাবে এই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪
টিআর/এইচএ