বগুড়া: প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। চল্লিশ কেজি ওজনের জোয়াল কাঁধে নিয়ে বিরামহীন ঘুরে চলেন ষাটোর্ধ্ব দুদু প্রামাণিক ও তার স্ত্রী হালিমা বেগম।
অবশেষে তাদের এ কষ্টের অবসান ঘটছে। অসহায় এই বৃদ্ধ দম্পতিকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তুলে দিয়েছেন র্যাব-১২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মারুফ হোসেন।
সোমবার (২৫ মার্চ) বিকেলে বগুড়া র্যাব ক্যাম্প অফিসে এই অসহায় পরিবারের হাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাটি তুলে দেওয়া হয়।
এ সময় অধিনায়ক মারুফ বলেন, ‘আমরা সব সময় পরিবারটির পাশে থাকব। ’ এছাড়া দুদু মিয়ার নাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে সহায়তা করার কথাও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের ছাইহাটা গ্রামে স্বামী-স্ত্রীর কাঁধে জোয়াল নিয়ে তেলের ঘানি টেনে সরিষা থেকে তেল বের করার দৃশ্য। ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ শব্দে ঘুরছে খুবই পুরোনো আমলের একটি ঘানি। ঘানি টানছেন বৃদ্ধ দম্পতি। তাদের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে শরীরের ভেতরের পানি ফোঁটা ফোঁটা ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসছে। কপাল বেয়ে মাথার ঘাম পড়ছে মাটিতে। তবু অনবরত ঘুরছেন তারা। আর তাতে ঘানি বেয়ে পাত্রে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা তেল। এভাবে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী মিলেই ঘানি টেনে সচল রেখেছেন সংসারের চাকা।
দুদু প্রামাণিক বাংলানিউজকে জানান, তিনি তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। এই পেশা তাদের বাপ-দাদার আমলের। তাদের আগে ছিল গোয়ালভরা গরু, বসতভিটাসহ বেশ কিছু কৃষিজমি। অনেক আগেই বাঙালি নদী ভাঙনের শিকার হন তিনি। সামান্য জমি কিনে ছাইহাটা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। একমাত্র ছেলে মানিক প্রামাণিকও অভাবী। ছেলের ঘরের সাত বছরের এক নাতি দুরারোগ্য রোগে ভুগছে। প্রতিমাসে তাকে রক্ত দিতে হয়। নাতির চিকিৎসাসহ, সংসারের অভাব-অনটনে ঘানি টানতে গিয়ে ও মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময় শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকু বিক্রির পর ঋণ পর্যন্ত করতে হয়েছে তার। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই গরুর বদলে তেলের ঘানির জোয়াল কাঁধে নেন। সারাদিন যা তেল পান তা বাজার বা গ্রামে বিক্রি করে চলে তার সংসার। এ কাজে তার স্ত্রী হালিমা বেগম তাকে সহযোগিতা করেন। তিনিও কাঁধে জোয়াল নিয়ে তেলের ঘানি টানেন।
তিনি আরও জানান, অনেক চেষ্টা করেও গরু কিনতে না পেরে জীবন বাঁচানোর তাগিদে স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু করেন ঘানি টানার কাজ। প্রতিদিন ছয় থেকে সাত কেজি সরিষা ভেঙে পৌনে দুই লিটার তেল তৈরির পর বাজারে বিক্রি করে যা টাকা পান, তা দিয়ে কষ্টে চলে তাদের সংসার। এ বয়সে আর পারি না। তার পরও পেটের দায়ে করতে হয়। তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে একই গ্রামের বাসিন্দা ফজর আলী দুদু মিয়াকে বসবাস করার জন্য সামান্য জায়গা দিয়েছেন। সেখানেই তারা বসবাসের পর কাঠের ঘানি টেনে তেল তৈরির কাজ করে কষ্টে দিনাতিপাত করে আসছেন তারা।
দুদু প্রামাণিকের স্ত্রী হালিমা বেগম জানান, প্রতিদিন ঘানি টানার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। রান্নাবান্না করতে পারি না। পা ফুলে যায়। চোখে ঝাপসা দেখি। গ্রামে ঘুরে সরিষা কেনা, তা দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে পাওয়া তেল, খৈল বাজারে বিক্রি করে সামান্য লাভে অভাব দুর হয় না।
প্রতিবেশীরা জানান, দুদু প্রামাণিক ও তার স্ত্রীর মতো দুর্ভাগা এই গ্রামে আর নেই। ঘানি টানলে খাবার জুটে, না টানলে অনাহার থাকে পরিবারটি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি তাদের দুরবস্থা বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসে। এটা দেখে গত ১৯ মার্চ জগলুল আহসান নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তা তাকে একটি গরু কিনে দিয়েছেন এবং তেলের ঘানিটি মেরামত করতে নগদ অর্থ প্রদান করেন। তবে গরু দিয়ে এখনও ঘানি টানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গরুটিকে ঘানি টানার জন্য প্রস্তুত করতে আরও সময় লাগবে। আর অটোরিকশাটি চালানোর জন্য তার ছেলেকে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৪
কেইউএ/এসএম