সাভার (ঢাকা): সাভারের আশুলিয়ায় যাত্রীদের মারধরে নয়, ইতিহাস পরিবহনের চালক ও কন্ডাক্টরের মৃত্যু হয়েছে আরেক গাড়ির সঙ্গে তাদের গাড়ির রেষারেষির সময়। দুই বাসের মাঝে পড়ে গুরুতর জখম হন দুজন।
আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় এমন তথ্যই জানিয়েছেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস্) আব্দুল্লাহিল কাফি। এর আগে সোমবার (৮ এপ্রিল) দুপুর ২টায় আহত অবস্থায় ওই দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তারা মারা যান।
নিহত দুজন হলেন- গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার ফোরকান হোসেনের ছেলে ও ইতিহাস পরিবহনের চালক সোহেল রানা বাবু (২৬) এবং ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে বাসটির কন্ডাক্টর হৃদয় (৩০)। তারা রাজধানীর মিরপুরে থাকতেন এবং ইতিহাস পরিবহনে চালক ও কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতেন।
পুলিশ জানায়, মূলত আব্দুর রহমান স্টিয়ারিংয়ে বসে বাসটি চালাচ্ছিলেন। নিহত দুজনের একজন ছিলেন গাড়ির দরজা সোজা সড়কে, অপরজন ছিলেন গাড়ির দরজায়। আব্দুর রহমান আরেক বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তার গাড়ি আকস্মিক বাঁয়ে চাপ দেন। তখন সোহেল ও হৃদয় দুই বাসের মাঝে পড়ে গুরুতর আঘাত পান। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। সেখানে দুজনের মৃত্যু হয়। ঘটনার সময় আব্দুর রহমান বাস থেকে নেমে পালিয়ে যান। পরে ফিরে এসে পুলিশ ও সাংবাদিকদের জানান, তিনি ওই গাড়ির হেলপার।
আব্দুর রহমান গতকাল (সোমবার) পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, মিরপুর থেকে ছেড়ে আসে তাদের গাড়ি। তারা ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিসের নামে বাড়তি ভাড়া চান। প্রায় সব যাত্রীই বেশি ভাড়া দেন। তবে একজন যাত্রী বেশি ভাড়া দিতে রাজি হননি। এ নিয়ে চালক-কন্ডাক্টরের সঙ্গে ওই যাত্রীর বাকবিতণ্ডা হয়। এর জেরে ওই যাত্রী মোবাইল ফোনে কল করে তার সহযোগীদের খবর দেন। পরে তার ১০ সহযোগী গাড়িতে উঠে চালক ও কন্ডাক্টরকে বেধড়ক মারধর করেন। তাদের উদ্ধার করে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন মারা যান।
আশুলিয়া থানা পুলিশ জানায়, দুজনের মরদেহের প্রাথমিক সুরতহালে ১০-১২ জনের মারধরের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায়নি। একজনের পিঠে একটি আঘাতের চিহ্ন এবং অপরজনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এতে সন্দেহ হয় পুলিশের। পরে হেলপার পরিচয় দেওয়া আব্দুর রহমানকে খুঁজে বের করে পুলিশ। তিনি প্রথমে একরকম ভাষ্য দিলেও সন্দেহ থেকে তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এই জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সোমবারের ঘটনার বর্ণনা দেন। এতে উঠে আসে, মূলত নিজেকে বাঁচাতে তিনি মিথ্যা গল্প সাজিয়েছিলেন।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি বাংলানিউজকে বলেন, আব্দুর রহমান নিজেকে বাঁচাতে যাত্রীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। গতকাল সাংবাদিক ও পুলিশের কাছে যে বক্তব্য আব্দুর রহমান দিয়েছিলেন, তাতে আমাদের খানিকটা সন্দেহ হয়। তার বক্তব্য ছিল, ১০-১২ কিংবা ১৫ জন ব্যক্তি মিলে বাস থেকে নামিয়ে দুইজনকে পিটিয়ে আহত করে। কিন্তু প্রাথমিক সুরতহালে এমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করি আমরা। তদন্ত করতে গিয়ে আমরা একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে পাই। যিনি আমাদের জানান, এখানে দুইবাসের মাঝে চাপা খেয়ে সোহেল ও হৃদয় আহত হন। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সেখানে দুজনের মৃত্যু হয়। আমাদের হাইওয়ে পুলিশের র্যাকার কর্মকর্তা ওই বাসটি সড়ক থেকে সরিয়ে নিতে গিয়েছিলেন, তার বক্তব্যেও সেখানে মারামারির কোনো তথ্য পাইনি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, এই প্রেক্ষাপটে আজ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অর্থাৎ যিনি বাসের হেলপার পরিচয় দিয়ে এই ঘটনাগুলি বলেছিলেন, তার সঙ্গে আবারও আমরা কথা বলি। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি প্রাথমিকভাবে এরকম বলেন যে, ওই সময় তিনি নিজেই বাসটি চালাচ্ছিলেন। ‘মা-বাবার দোয়া পরিবহন’র অন্য একটি বাস তাদের বাম পাশে ছিল। সেই বাসটি যখন আগে যাচ্ছিল, তখন আব্দুর রহমান নিজে আগে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা করে তার গাড়ি বামে চাপান। নিহত দুইজনের একজন রাস্তায় ছিলেন অর্থাৎ বাসের নিচে ছিলেন। আরেকজন বাসের গেটের দিকে ছিলেন। ইতিহাস পরিবহনের বাসটি যখন আকস্মিক বামে চাপানো হয়, তখন ওই দুইজন বামে থাকা ‘বাবা মায়ের দোয়া’ নামের বাসটির সঙ্গে চাপা খান। এতে তারা আহত হলে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। প্রাথমিকভাবে তদন্তে আমরা এতটুকু পেয়েছি।
আব্দুল্লাহিল কাফি আরও বলেন, ময়নাতদন্ত করা হয়েছে এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও তদন্ত করে আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো আসলে সেদিন কী ঘটেছিল। প্রাথমিকভাবে আব্দুর রহমান গতকাল যা বলেছেন, তার সঙ্গে আজকের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। ঘটনা ঘটার পর বাস থেকে লাফিয়ে তিনি পালিয়ে যান। তার গায়ে কালো শার্ট ছিল। এটি প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য। আজ তার বক্তব্যে উঠে এসেছে; তিনি মামলা, শাস্তি কিংবা জেলের ভয়ে গতকাল যাত্রীদের মারধরের গল্প সাজিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তার যে দুইজন সঙ্গী ছিলেন, দুইজনই যেহেতু মারা গেছেন, এত ব্যস্ত সড়কে হয়তো বিষয়টি কেউ খেয়াল করবে না। বোধ হয় এভাবে বললে এটি বিশ্বাসযোগ্য হবে। এটি প্রাথমিকভাবে তিনি স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০২৪
এইচএ/