কক্সবাজার: প্রচণ্ড খরতাপে পুড়ছে মানুষ প্রাণীকুল, পুড়ছে প্রকৃতি। প্রকৃতির এমন বৈরীতায় জনজীবন যখন স্তব্ধ, ঠিক এ মুহূর্তে সবার প্রার্থনা বৃষ্টি নামুক, বৃষ্টি নামুক।
অনুষ্ঠানের শুরুটা একঝাঁক ক্ষুদে শিল্পীর সমবেত ‘তবলা লহড়া’ দিয়ে হলেও এর পরেই ছিল, ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ তানসেন এর ‘মিঞা কি মালহার’ রাগ ‘পনঘট মুরুলিয়া’র পরিবেশনা। ঐশী বিশ্বাস, তৃষা বিশ্বাস, মহি বিশ্বাস, ঋদিমা দেবনাথ ও হিমাদ্রি পাল হিয়ার পঞ্চকণ্ঠে এটি দারুণ উপভোগ করেছেন সঙ্গীত পিপাসুরা।
রাগটিকে ‘মিঞা মালহার’ অনেকেই আবার ‘মিঞা কি মল্লার’ ও বলতে শুনি। মূলত বর্ষার রাগ এটি। এ রাগ দিয়ে বৃষ্টিকে পৃথিবীর বুকে স্বাগত জানানো হয়। মিঞা মালহার খুব বড় রাগের একটি। যে রাগে কানাড়া ও মালহারের সমাবেশ ঘটেছে।
শুধু তাই নয়, প্রতিভাবান ক্ষুদে শিল্পীর প্রতিটি পরিবেশনা ছিল চমকপ্রদ, হৃদয়গ্রাহী। প্রায় ৩২ জন ক্ষুদে শিল্পীর সমবেত তবলা লহড়া দারুণ অভিভূত করেছে দর্শকদের।
গত বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কক্সবাজার ইনস্টিটিউট অব পাবলিক লাইব্রেরির শহীদ সুভাষ হলে কক্সবাজারের স্থানীয় সংগঠন ‘দয়া সংগীত একাডেমি’র প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করে গুণীজন সম্মাননা ও লহড়া অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র-নজরুল,আধুনিকের পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে উচ্চাঙ্গ সংগীত।
ভারতীয় উপমহাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শ্রুতিমধুর রাগ ‘দেশ’। মূলত এটি মধ্যরাত্রির রাগ। ঋদিমা দেবনাথের কণ্ঠে এ রাগের সঙ্গে স্বরলিপি ধরের নৃত্য যেন মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।
‘ভাব প্রধান ও শৃঙ্গার রসাত্মক কিন্তু চপলতা বর্জিত ক্ষুদ্র আকারের গায়নশৈলী বা গানকে ‘ঠুমরি’ বলা হয়। শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে ধ্রুপদ ও খেয়াল রাগের শুদ্ধতা রক্ষা করে, রাগের নানা রকম সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু ‘ঠুমরি’তে তেমনটা করা হয় না। এ গানে কথার ভাবকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুরের মাধুরী মিশিয়ে কথাকেই নানাভাবে প্রকাশ করার ফলে ‘ঠুমরি’ একটি বিশেষ আবেদন তৈরি করে। ’ যেমনটি করেছিল ঋদিমা দেবনাথ।
এভাবেই চমকপ্রদভাবে কথার মাধুরীতে ঠুমরি আর দর্শকদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী মানসী বড়ুয়া। অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার হলেও দর্শকদের খুব একটা ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। দীর্ঘ ব্যাপ্তির এ আয়োজনে ছিল বেশ কয়েকটি একক সংগীতও। ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন’ গানটি দারুণ গেয়েছেন ঈপ্সিতা চক্রবর্তী। ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’ হিমাদ্রী পাল, ‘বেঁধেছি বিনা’ অদিতি বড়ুয়া, ‘লোকে বলে রাগ নাকি অনুরাগের আয়না’ মোহি বিশ্বাস ও ‘আমি যে জলসা ঘরে’ গানটি দারুণ লেগেছে ঐশী বিশ্বাসের কণ্ঠে।
অনুষ্ঠানের আরেকটি ভালো লাগার দিক ছিল গুণীজন সম্মাননা। এ পর্বে পাঁচ গুণী শিল্পী ও একজন চিকিৎসককে সম্মাননা দেওয়া হয়। সেই গুণীজনেরা হলেন প্রয়াত সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, ম্যান্ডোলিন শিল্পী আমান উল্লাহ, জেলার শ্রেষ্ঠ মৃৎশিল্পী নেপাল ভট্টাচার্য্য, বিশিষ্ট নাট্য নির্দেশক স্বপন ভট্টাচার্য্য, কোলকাতার তবলা শিল্পী, পুরো বাংলাদেশে তবলা শিক্ষার প্রসারে যার অগ্রণী ভূমিকা সমীর আচার্য্য, বিশিষ্ট শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অরূপ দত্ত বাপ্পী ও শুদ্ধ সংগীতে যার অবদান অশেষ মৃদুল চৌধুরী।
দয়া সংগীত একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সজল দের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষন কান্তি দাশ। আরও অতিথি ছিলেন কক্সবাজার থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত, কক্সবাজার বেতারের সংগীত প্রযোজক বশিরুল ইসলাম, সম্মিলত সাংস্কৃতিক জোট, কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক মো. নজিবুল ইসলাম, খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ সরওয়ার সোহেল প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভীষন কান্তি দাশ বলেন, আমি অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছি, আজকের ভালো লাগা অন্যরকম। বিশেষ করে একঝাঁক ক্ষুদ শিল্পীর তবলা লহড়া আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। আমি বিশ্বাস করি, এ শিশুরাই কক্সবাজারকে একদিন সংস্কৃতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবে।
অনুষ্ঠানের শেষ নিবেদনে ভারতের কোলকাতার শিল্পীদের যন্ত্রসংগীত পরিবেশনা দর্শকদের মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। এ দলে ছিলেন অরণ্য শর্মা, দিলীপ বিশ্বাস ও সমীর আচার্য্য।
শুরুতেই বলেছিলাম, একঝাঁক ক্ষুদে শিল্পী তবলা লহড়ার মাধ্যমে যারা দর্শকদের চমকে দিয়েছেন, এরা হলো অরিত্র গুহ, ঋষিকা দে, স্বচ্ছ দে, অভিজিৎ শর্মা অভি, প্রীতম বড়ুয়া অর্থ,অনিন্দ্য তালুকদার, আদিপ্ত পাল, অর্ক ধর, অংকুশ ধর, পুঞ্জ বড়ুয়া, ঋষিক দেবনাথ, নিলয় দে, আদ্রিক বিশ্বাস সুপ্ত, প্রিয়ন্ত ধর আদি, ইমু ধর, সৃজন দাশ, সুপ্রিয় দাশ, শ্রেয়ান দাশ, অমিত দেব, অন্তু দাশ, বিনয় রক্ষিত, শাওন দে প্রান্ত বৈঞ্চব, বর্ষন দাশ, জয়িতা বিশ্বাস, ইভান ধর, প্রীতম ধর, শয়ন দে, ঐন্দ্রিলা বড়ুয়া তোড়া, নবন্ন বড়ুয়া তীব্র, অর্জন দে ও শুভ ব্রত পাল।
পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে যন্ত্রানুসঙ্গে ছিলেন কি-বোর্ডে সৈকত নন্দী, অক্টোপ্যাড রবিন চৌধুরী ও গিটারে মুজিবুর রহমান।
শেষ করতে চাই, অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মানসী বড়ুয়ার প্রার্থনা দিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি মানুষ স্বপ্ন দেখেন। তবে কেউ কেউ স্বপ্নকে ছুঁতে সক্ষম হন না। আমাদের প্রিয় সজল (সজল দে) স্বপ্ন দেখেছেন একটি শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়বেন। সেই পথেই তিনি হাঁটছেন। যে বীজ তিনি বপন করেছিলেন, সেটি ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। সেই চারাগাছটি হাঁটিহাঁটি পা পা করে আজ এক বছর পূর্ণ করেছে। এটি একদিন মহীরুহ হবে। এ হোক সকলের শুভ প্রার্থনা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০২৪
এসবি/আরআইএস