ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সিলেটের তিন টোল প্লাজায় মাসে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, মে ৬, ২০২৪
সিলেটের তিন টোল প্লাজায় মাসে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ টোল আদায় হচ্ছে শেরপুর টোল প্লাজায়

সিলেট: সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ চলায় না এগিয়ে উল্টোপথে সিলেটের সড়ক ও জনপথের (সওজ) কর্মকর্তারা।  

তারা এনালগ পদ্ধতিতে টোল আদায় করছেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর টোল প্লাজায়।

ডিজিটাল যুগে হাতে কলমে রশিদ কেটে টোল আদায় করা হচ্ছে সেখানে। এতে আর্থিক তছরুপ চলছে।

কেবল ফেঞ্চুগঞ্জ টোল প্লাজা-ই নয়, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে কুশিয়ারা নদীর ওপর শেরপুর সেতু ও নগরের প্রবেশদ্বার শাহপরাণ (র.) বাইপাস সেতুর টোল আদায়ের অর্থও বিশেষ কায়দায় তছরুপ করা হয়।  

যদিও দুটি টোল প্লাজায় সফটওয়্যার কার্যকর আছে। তবে, যাতায়াতকারী যানবাহন থেকে টোল আদায় করা হলেও অনেক সময়ই সফটওয়্যারের জটিলতা দেখিয়ে আগের প্রিন্ট করা রশিদ দেওয়া হয়। এমন অভিযোগ চালকদের।

প্রতি মাসে কোটি টাকা টোল আদায় (খাস কালেকশন) করা হলেও সফটওয়্যারে নেই সঠিক কোনো হিসেব। সওজ কর্মকর্তারা প্রতিদিনের বিপুল পরিমাণ টাকা টোল আদায় করলেও ব্যাংকে জমা দেন ইচ্ছে মাফিক। আর বিশাল অঙ্কের টাকা ভাগবাটোয়াতে চলে যাওয়ায় সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বেহাত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই তিন সেতুর থেকে মাসে অন্তত সোয়া দুই কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। অথচ ব্যাংকে জমা হয় এক কোটি ২০ লাখ থেকে এক কোটি ২২ লাখ টাকা। এ হিসেবেই মাসে প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব লোপাট হয় এই তিন টোল প্লাজায়।  

প্রতি ২৪ ঘণ্টায় আদায়কৃত টোলের টাকা রাতেই নিয়ে যান সওজের কর্মকর্তারা। সরকারের রাজস্ব আদায়ের অর্থ রহস্যজনক কারণে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর পকেটেই পড়ে থাকে ৬ থেকে ১০ দিন। এরপর যে পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা হয় তাও ইচ্ছে মাফিক।

খোদ কর্মকর্তাদের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, তিনটি টোল প্লাজা থেকে প্রতিদিন ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা আদায় হয়ে থাকে। সে হিসেবে মাসে এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকে ছয় দিনে জমা হয়েছে ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ হিসেবে প্রতিদিন ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৬ টাকা আদায় দেখানো হয়েছে। বাকি টাকা বিশেষ কায়দায় তছরুপ করা হয়েছে। যদিও আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের।

ব্যাংকে জমা দেওয়া হিসাব থেকে জানা যায়,  এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৩টি টোল প্লাজা থেকে আদায়কৃত ২৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে। এরমধ্যে শেরপুর টোল প্লাজার ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৬ টাকা আদায় দেখানো হয়। ফেঞ্চুগঞ্জ টোল প্লাজায় এই ছয়দিনে ৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৭৩ হাজার ১৬৬ টাকা এবং শাহপরান সেতুতে প্রতিদিন গড়ে ৮২ হাজার ২৬৬ টাকা আদায় দেখিয়ে ছয়দিনে ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি টোল প্লাজায় এশিয়ান ট্রাফিক অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড (এটিটি) টোল আদায়ের দায়িত্বে ছিল। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করা এবং মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত বছরের পহেলা অক্টোবর থেকে টোল প্লাজাগুলোর অর্থ আদায়ের দায়িত্ব বুঝে নেয় সড়ক ও জনপথ (সওজ), সিলেট। কিন্তু সওজ দায়িত্ব নিলেও দীর্ঘ সাত মাস ফেঞ্চুগঞ্জ টোল প্লাজার কম্পিউটার বিকল রেখে হাতে কলমে রশিদ দিয়ে টোল আদায় হয়। অপর দুটি টোল প্লাজা শেরপুর ও শাহপরান বাইপাসে সফটওয়্যারের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন হলেও বিশেষ কায়দায় এ দুটিতে নয়ছয় করার অভিযোগ পাওয়া যায়।

এনালগ পদ্ধতিতেই রশিদ কেটে টোল আদায় হচ্ছে ফেঞ্চুগঞ্জ প্লাজায়

তিনটি টোল প্লাজায় সওজের তিন কার্যসহকারী ও কর্মকর্তাদের মনোনীত আরও ৩ জনকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়ে আদায়কৃত টোলের টাকা গচ্ছিত রাখা হয়। সেই টোলের টাকা প্রতি রাতে নিয়ে আসেন কর্মকর্তারা পরদিন জমা দিতে, এমনটি জানান টোল আদায় কাজে নিয়োজিত সওজের কর্মচারীরা।

সিলেট সড়ক ও জনপথ বিভাগের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে কার্যসহকারী পদে কর্মরত রয়েছেন ১০ জন। এরমধ্যে তিনটি টোল প্লাজায় দায়িত্ব পালন করছেন ৩ জন।  

তারা হলেন - সিলেট সড়ক উপ-বিভাগ এর কার্যসহকারী মিঠু দাস ও সৌরভ কান্তি কর এবং গোলাপগঞ্জ সড়ক উপ-বিভাগের সাধন সরকার। অন্য তিনজন সওজের তিন কর্মকর্তার খাস লোক। তারাই টোল প্লাজার আদায় হওয়া টাকা সংরক্ষণের মূল দায়িত্ব পালন করেন।  

ফেঞ্চুগঞ্জ টোল প্লাজা

এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সড়ক উপ-বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাদ্দাম হোসেন। তিনি জানান, মাস্টাররোলে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী।

দায়িত্বরতরা জানান, প্রতিরাতে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী, কখনো এসডিও বা এসও টাকা উত্তোলনে যান। টোল প্লাজার দায়িত্বরতদের বের করে দিয়ে আদায়কৃত খাস কালেকশনের পুরো টাকা নিয়ে আসেন তারা। কত টাকা নিলেন, তার পরিমাণ বা হিসেবও দেন না টোল প্লাজার দায়িত্বে থাকা সওজের কার্যসহকারীদের।

 তিনটি টোল প্লাজা সম্প্রতি পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, বিভিন্ন যানবাহনের মধ্যে ট্রেইলার থেকে ৩৭৫ টাকা, বড় ট্রাক ১১০, মাঝারি ট্রাক ৮৫, বাস ৩৫, মিনি ট্রাক ৬৫, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যান ৬০, মিনিবাস ২৫, মাইক্রোবাস ৪০, কার ২০, তিন চাকার যান ১০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। চলাচলকারী যানের মধ্যে মহাসড়কে শেরপুর সেতু পারাপার হয় সবচেয়ে বেশি বাস, ট্রাক, কার ও মাইক্রোবাস।

সরেমজিন দেখা গেছে, এক ঘণ্টায় শেরপুর সেতু অতিক্রম করে ৪৮৮টি যানবাহন। ২৪ ঘণ্টা হিসেব করলে গাড়ি অতিক্রমের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭১২টি। গড়ে ৫০ টাকা আদায় হিসেবে এসব গাড়ি থেকে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা টোল আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি কোষাগারে টাকা জমার হিসাব ৩ লাখ অতিক্রম করে না। একইভাবে ফেঞ্চুগঞ্জ সেতু দিয়ে ঘণ্টায় দেড় শতাধিক ও শাহপরাণ (রহ.) সেতু দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় শতাধিক করে যানবাহন অতিক্রম করে। সে হিসেবে লক্ষাধিক থেকে ২ লাখ টাকা জমা হওয়ার কথা। কিন্তু মনগড়া হিসেব দেখিয়ে ইচ্ছে মাফিক টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়।

শাহপরান টোল প্লাজা

এ বিষয়ে সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, আমরা গত বছরের অক্টোবর থেকে তিনটি টোল প্লাজায় খাস কালেকশনের দায়িত্ব নিয়েছি। প্রতিদিনের টাকা একদিন পরে জমা দেওয়া হয়। তবে সেটি দেখেন সাব ডিভিশন অফিসার (বিশ্বনাথ সড়ক উপ-বিভাগ উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মাহামুদুল হাসান)। তিনি (নির্বাহী প্রকৌশলী) নতুন এসেছেন, তাই অনেক কিছু জানেন না।

সড়ক উপ-বিভাগ উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিও) মো. মাহামুদুল হাসান বলেন, আগে যে কোম্পানি টাকা আদায় করতো। তাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে, মেথডও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে সওজ টোল আদায় করছে। প্রতিদিনের টাকা প্রতিদিন এনে পরদিন জমা দেওয়া হচ্ছে।  

ফেঞ্চুগঞ্জ টোলপ্লাজার সফটওয়্যার ঠিক না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের সফটওয়্যার সরিয়ে নিয়েছে। তাই ওই টোল প্লাজায় নতুন করে সফটওয়্যার সেটিং করা হয়নি। এই টোল প্লাজা থেকে দিনে গড়ে ৮০-৯০ হাজার টাকা, শেরপুর থেকে ৩ লাখ টাকা এবং শাহপরান টোল প্লাজা থেকে ৮০ হাজার টাকার আদায় হয়ে থাকে।

সিলেট সওজ - এর নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসন, এসডিও মাহমুদুল হাসান ও এসও সাদ্দাম হোসেন (বাঁ থেকে)

সড়ক উপ-বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমি শেরপুর টোল প্লাজার টাকা সংগ্রহ করি। অন্য দুটি টোল প্লাজার টাকা আদায় করেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী কুতুব উদ্দিন। শেরপুর থেকে প্রতিদিন ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার কমবেশি টোল আদায় হয়ে থাকে। সেই টাকা ৩/৪ দিন পর সোনালী ব্যাংকে চালান মারফত জমা দেওয়া হয়। তিনটি টোল প্লাজায় কার্যসহকারীদের পাশাপাশি ম্যানেজার হিসেবে মনোনীতরা মাস্টাররোলে আছেন। মাস্টাররোলে যে কেউ নিয়োগ পেতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৪ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০২৪
এনইউ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।