ঢাকা: মাশফিকুর রহমান মুকুলের বাসা ঢাকায়৷ বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে ইচ্ছুকদের ইতালিয়ান ভাষা শেখান। যারা পরে ইতালির ভিসার জন্য আবেদন করে থাকেন।
তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে প্রচুর ক্লায়েন্ট ইতালিয়ান ভাষা শিখেছে। যারা ভাষা শিখে ফেলে তাদের ইতালি থেকে নুলস্তা (ওয়ার্ক পারমিট) নামের একটি কাগজ পাঠানো হয়। সেই নুলস্তা আসার পরে ভিসার আবেদন করতে হয়। তবে ভিসা আবেদনের জন্য যে সিরিয়াল প্রয়োজন সেটা সহজে পাওয়া যায় না।
মুকুল বলেন, আমি নিজেও আমার এক ভাইয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সিরিয়াল নিয়েছি। ওখানে গেলে দেখবেন যে, প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ এই টাইপের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মুকুলের মতো প্রতিদিন শত শত বিদেশ গমনেচ্ছু হাজার হাজার টাকা দিয়ে ভিএফএসের সিরিয়াল নিচ্ছেন।
গত ১৩ মে রাজধানীর গুলশান-১ নম্বর সার্কেলে নাফি টাওয়ারে অবস্থিত ভিএফএস গ্লোবালের কার্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অনেক ভিসাপ্রত্যাশী তাদের পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। সেখানে গিয়ে কথা হয় অনেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে। ভিসাপ্রত্যাশী ছাড়াও অনেক দালালকেও সেখানে অবস্থান করতে দেখা যায়।
ভিএফএস গ্লোবালে দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশে ইতালি দূতাবাস ভিএফএস গ্লোবালের সঙ্গে ভিসা প্রদানসহ যাবতীয় সেবা নির্দিষ্ট ফি-র বিপরীতে সম্পাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। বাংলাদেশসহ ১৪৭টি দেশে ভিসা প্রক্রিয়ার কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে তারা তাদের সার্ভিস দিয়ে থাকে। তবে ঢাকা বাদে বাকি দুই জেলায় শুধু প্রিমিয়াম সার্ভিস দেয় ভিএফএস গ্লোবাল। ঢাকায় প্রিমিয়াম সার্ভিসের পাশাপাশি সাধারণ সার্ভিসও চালু রয়েছে।
ভিএফএস গ্লোবাল ভিসা প্রসেসিং খরচ বাবদ জনপ্রতি ১৯ হাজার ৭২০ টাকা থেকে ২২ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ভিসাপ্রত্যাশীরা কাগজপত্র জমা এবং সাক্ষাৎকারের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বুকিং বা অ্যাপয়েমেন্ট গ্রহণ করে থাকেন। ২০২২ সাল থেকে এ অ্যাপয়েন্টমেন্ট সহজলভ্য হলেও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য কালোবাজারি এবং ভিএফএসের যোগসাজশে একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ভিসাপ্রত্যাশীরা নিজে চেষ্টা করে কোনোভাবেই ওয়েবসাইটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারেন না। ভিএফএসের নোটিশ মোতাবেক, প্রতি মাসের ২৫ তারিখ পরবর্তী মাসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রদান করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ৯টায় অনলাইনে স্লট ওপেন করলে প্রথম ৩ মিনিটে তিন হাজার অ্যাপয়েন্টমেন্ট শেষ হয়ে যায়।
ভিসাপ্রত্যাশীরা অভিযোগ করে বলেন, দালালদের ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিলে রাতারাতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। এর জন্য ওটিপি বা কোনো বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয় না। অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে অনলাইনে আবেদন করলে ওটিপি আসতে সময় লাগে ৯ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা।
‘খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি ভাই’
শরীয়তপুর থেকে আসা ভিসাপ্রত্যাশী ভুক্তভোগী মাসুদ রানা বলেন, আমরা খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি ভাই। আজকে সাত-আট মাস ধরে জমা দিয়েছি, আমাদের বউ-পোলাপান আছে, বাবা-মা আছে, অনিশ্চিত জীবন ভাই আমাদের।
এখন কী বলছে তারা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন বলে যে, প্রসেসিংয়ে আছে। যেদিন মেসেজ দেব, সেদিন আসবেন। ঢুকতেই তো দেয় না ওরা। এই হলো অবস্থা। কবে যে পাব সেটারও কোনো নিশ্চয়তাও নাই।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাসিন্দা ভুক্তভোগী মো. মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা ওনাদের এখানে নুলস্তা পাইছি প্রায় চার মাস হয়ে গেছে। আমাদের অ্যাপয়েটমেন্ট দেওয়ার কথা এক মাসের মধ্যে। ১ মার্চ ওদের কাছে মেইল করি, প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত আমাদের দিচ্ছে না। আমাদের আপডেট কিছু জানাচ্ছেও না যে, আপনারা পাবেন বা সামনে দিয়ে দেব। নুলস্তা নিয়ে আমরা এখন হয়রানির মধ্যে আছি, টাকা পয়সা দিয়েছি, এখন এখানে ডেট পাচ্ছি না।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বাসিন্দা শাহীন খান বলেন, আমি একজন সৌদি প্রবাসী, আমার এক বন্ধু ইতালি থাকে। তার মাধ্যমে ভিএফএসে আবেদন করেছি। তখন আমার নুলস্তা ওঠে। এরপরে আমি বাংলাদেশে আসি। আসার পরে আমি জমা করি গত বছরের আগস্টের ৮ তারিখে। এখনো এটার ভিসা হয়নি। আমার পাসপোর্টও ব্যাক পাইনি। আমার আগামী মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত সৌদি আরবের ভিসা আছে, আমি এখন যদি ১৫ দিনের মাঝে পাসপোর্ট পাই, ইতালির ভিসা না পাইলেও আমি সৌদিতে যেতে পারব।
তিনি আরও বলেন, আমি একজন সফল প্রবাসী। সৌদি আরবে আমার গাড়ি আছে, আমি এখনো গাড়িটাও বিক্রি করিনি।
এ পর্যন্ত কতবার আসতে হয়েছে আপনার? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি তো অনেকবার এসেছি। কোনো রেসপন্স নাই। ওদের কাছে গেলে বলে, আমরা আপনাকে মেসেজ দেব রেডি হলে, আপনি এসে ভিসা নিয়ে যাবেন। এখন রেডি যে কবে হবে আল্লাহ পাক জানে। আগামী মাসের ৬ তারিখের মাঝে পাসপোর্ট না পেলে সৌদি আরবেও যেতে পারব না। সব দিকেই শেষ।
ভিএফএস যা বলছে
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান শান্তনু ভট্টাচার্য বলেন, দেখুন, ভিসা ইস্যুয়েন্স তো আমাদের হাতে নেই। ভিসা ইস্যুয়েন্স দূতাবাস করে। আমরা আবেদনপত্র সংগ্রহ করি। ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি দূতাবাসের হাতে। সেটা দূতাবাসই বলতে পারবে কেনো সময় লাগছে। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা উচিত নয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২৪
এসজেএ/এইচএ/