ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সিরিয়াল কিলার এরশাদ শিকদারকেও ছাড়িয়ে গেছেন শিমুল ভূঁইয়া!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২৪
সিরিয়াল কিলার এরশাদ শিকদারকেও ছাড়িয়ে গেছেন শিমুল ভূঁইয়া! খুলনার চরমপন্থি নেতা সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া

খুলনা: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আলোচনায় খুলনার সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া।  

তাকে অন্ধকার সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট বলে জানেন খুলনার বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা বলছেন, অপরাধ জগতে খুলনার কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এরশাদ শিকদারকে ছাড়িয়ে গেছেন শিমুল ভূঁইয়া।  

যদিও এই অপরাধীর বিষয়ে এতোদিন মুখ খোলেনি কেউ। তবে ভারতে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের তার নাম জড়িয়ে পড়ার পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে শিমুল ভূঁইয়ার অন্ধকার সাম্রাজ্যের নানা বর্ণনা।  

সূত্র জানায়, খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর এলাকার বাসিন্দা শিমুল। অসংখ্য হত্যার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ক্ষমতার দাপটে দিনকে রাত করতেন আর রাতকে দিন করতেন তিনি। খুলনাঞ্চলের নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল এমএল জনযুদ্ধের প্রধান শিমূল ভূঁইয়া। এ অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যার মূলহোতা তিনি। নিষিদ্ধ ঘোষিত এ সন্ত্রাসী দলটির কার্যক্রম না থাকলেও আঞ্চলিক নেতা শিমূল ভূঁইয়া বেশ বদল করে দলটির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। বছরের পর বছর ধরে সংঘটিত করে রেখেছেন এ সংগঠনের মতাদর্শীদের। অতীতের অপরাধ মুছতে খুলনার এই শীর্ষ চরমপন্থি নেতা নিজের তার পরিবর্তন করে আমানুল্লাহ রেখে পাসপোর্ট তৈরি করেন।  

দেশের অপরাধীদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত নামটি খুলনার এরশাদ শিকদারের। নৃশংস ও ভয়াবহতার দিক থেকে এরশাদ শিকদার সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়াল কিলার এরশাদ শিকদারকে হার মানিয়েছেন শিমুল ভূঁইয়া। এমনটি অভিমত খুলনার নাগরিক নেতাদের।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, খুলনার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও সিরিয়াল কিলার এরশাদ শিকদার তার নানা অপরাধের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নগরীর রেলস্টেশন ও ভৈরব নদীর ঘাট এলাকায়। নৃশংস ও ভয়াবহতার দিক থেকে তিনি সারা দেশে সবার শীর্ষে ছিলেন। তবে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক শিমুল ভূঁইয়ার অপরাধের জগৎ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেছেন। সেদিক বিবেচনা করে বলা যায় এরশাদ শিকদারকেও ছড়িয়ে গেছেন শিমুল ভূঁইয়া। ডিজিটাল যুগেও পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রে কীভাবে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করেছেন, সে বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

শিমুল ভূঁইয়ার ভয়ংকর হয়ে ওঠার গল্প:

১৯৮৬ সালে শিমুলের বোন লুচি খানমের সঙ্গে তার ফুফাতো ভাই ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলা সদরের ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের বিয়ে হয়। ডা. টুটুল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। ওই বছর ডা. টুটুলের পরামর্শ ও দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাম শিমুল নাম লেখান চরমপন্থি দলে। ১৯৯১ সালে তাকে খুলনায় পার্টির সদস্য করা হয়।

ছাত্রজীবনে চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে (এমএল) যোগ দিয়েছিলেন শিমুল। এরপর একের পর এক হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থি নেতায় পরিণত হন । তার ভয়ে তটস্থ ছিল খুলনার ফুলতলা উপজেলার মানুষ। তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৫টি হত্যাসহ দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।

শীর্ষ সন্ত্রাসী শিমুলের ‘আমলনামা’

খুলনাঞ্চলের শীর্ষ এ সন্ত্রাসী শিমুল ভুঁইয়া একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার পর সর্বশেষ তার নাম জড়িয়েছে ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে।

১৯৯১ সালের শেষের দিকে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিমুলসহ ৫ জন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শৈলগাতী বাজারে একটি সশস্ত্র গ্রুপের নেতা এমরান গাজীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর স্থানীয় লোকজন তাদেরকে ৩টি অস্ত্রসহ আটক করে পুলিশে দেন।

পরে এমরান গাজী হত্যা মামলায় শিমুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই মামলায় শিমুল ১৯৯১ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। পরে হাইকোর্টে আপিলের মাধ্যমে হত্যাসহ ৩টি মামলায় জামিনে মুক্তি পান।

শিমুল ১৯৯৬ সালে যশোর কারা বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ২২ ডিসেম্বর যশোর কোতয়ালী থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৪ এপ্রিল তার জামিন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জামিনের নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার পর পুনরায় আর আদালতে হাজিরা না দিয়ে পলাতক ছিলেন।

১৯৯১ থেকে ৯৭ সাল পর্যন্ত সাত বছর কারাগারে ছিলেন শিমুল। এরপর ইমান আলী নামের এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। দুই খুনের মামলায় ২০ বছরের মতো জেল খেটেছেন শিমুল।

কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০০৩ সালে শিমুলের ভাই মুকুল পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। ২০১৪ সালে কারামুক্ত হন শিমুল। এরপর থেকে এলাকার বাইরে ছিলেন। মাঝেমধ্যে গোপনে এলাকায় গেলেও কারও চোখে পড়েনি। বেশিরভাগ সময় আত্মগোপনে ছিলেন।  

খুলনার ফুলতলা উপজেলা সদরের দামোদর গ্রামের মৃত নাসির ভূঁইয়ার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে চতুর্থ শিমুল ভূঁইয়া। তিনি ১৯৯৭ সালে যশোর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরে খুলনা নগরীর বয়রা সিএসডি গোডাউন এলাকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আবুল কাশেমের মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তাকে বিয়ে করেন।

শিমুল ভূঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে মুক্তা বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। তার আরেক ভাই শিপলু ভূঁইয়া দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বর্তমান সরকারের আমলেই তারা আ.লীগের রাজনীতিতে যোগদান করেন। চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক শামসুর রহমান কেবল হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার পরেও শিমুলের কিছু হয়নি। সব শেষ নাম বদল করে আমানউল্লাহ নাম নিয়ে প্রায় মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন তার অন্ধকার অতীত।

আধিপত্যের কারণে ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট হত্যা করা হয় ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউপির চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা সরদার আবুল কাশেমকে।  

অভিযোগ আছে, হত্যার দিন দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে বসে থাকা অবস্থায় শিমুল তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে চেয়ারম্যানের মাথায় গুলি করেন। এরপর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আবুল কাশেমের বড় ছেলে সরদার আবু সাঈদ বাদল। ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার ঘটনায়ও শিমুল ভূঁইয়া সরাসরি অংশ নেন বলে অভিযোগ আছে।

ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম শুক্রবার (২৪ মে) বাংলানিউজকে বলেন, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৯টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তদন্তনাধীন রয়েছে ১টি। আমাদের কাছে ১৯৯৮ সালের পর থেকে আর কোনো রেকর্ড নেই। ১৯৯১ সালের বেশ কিছু হত্যা মামলার তিনি আসামি বলে শুনতে পেরেছি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৪ ঘণ্টা, মে ২৪,  ২০২৪
এমআরএম/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।