ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মেঘনার উপকূলজুড়ে রিমালের ক্ষতচিহ্ন

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৪
মেঘনার উপকূলজুড়ে রিমালের ক্ষতচিহ্ন রিমালের প্রভাব

লক্ষ্মীপুর: ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত মেঘনার উপকূলজুড়ে ক্ষতচিহ্ন তৈরি করে দিয়ে গেছে। ঝড়ের তাণ্ডবলীলা যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ।

 

মঙ্গলবার (২৮ মে) বিকেলে মেঘনার তীরবর্তী লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মাতব্বর হাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট।  

সোমবার (২৭ মে) দুপুরে মেঘনা নদীতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নদীর পাড়ের অনেকের ঘরবাড়ি নিয়ে গেছে। কারো কারো ঘরের মালামাল ভাসিয়ে নিয়েছে জোয়ারের পানি। বিধ্বস্ত হয়েছে অনেক বসতঘর। এতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে কেউ কেউ।

উপকূলের বাসিন্দারা জানায়, সোমবার দুপুর ১টার দিকে মেঘনার জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকতে শুরু করে।  

১৪ বছরের কিশোরী তাছলিমা আক্তার, ঝড়ের সময় বাবা-মাসহ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ঘরেই ছিল। বাংলানিউজের কাছে সেসময়ের অবস্থা বর্ণনা করেছে সে।  

তাছলিমাদের বসতি কমলনগর উপজেলার মাতব্বর হাট সংলগ্ন জনু বাইত্তানা বাড়িতে। তাদের বসতঘরটি মেঘনা নদী থেকে মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাত দূরত্বে। জোয়ার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি ঢুকে পড়ে তাদের বাড়িতে। দুপুর ১টার দিকে জোয়ার শুরু হয়। সেই সঙ্গে উঁচু উঁচু ঢেউয়ের কারণে সৃষ্টি হয় জলোচ্ছ্বাস।  

জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয় দুপুর ২টার পর। তাছলিমারা আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি। কারণ ঘরের মালামাল রেখে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী না তাদের এলাকার বাসিন্দারা।  

তাছলিমা বলে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘরেই ছিলাম। তখন ঘরে পানি উঠে গেছে। চৌকির ওপর আশ্রয় নিই। সেখানেও পানি। ঘরে আর থাকার অবস্থা নেই। পরে আমরা সবাই সাঁতরে গিয়ে গাছ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দুই ঘণ্টার মতো থাকার পর পানি নামতে শুরু করলে বাড়ির অদূরে অন্য আরেকটি বাড়িতে গিয়ে রাতে আশ্রয় নিই। এভাবে জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছি।  

এই কিশোরী যখন জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছিল তখন তার চোখমুখে অনিশ্চয়তার চাপ দেখা যায়। কারণ জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে তাদের বসতঘরটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ঘরে এখন আর বসবাসের মতো উপায় নেই। নেই খাবারও। রান্না করারও নেই কোনো ব্যবস্থা। কিন্তু তাদের এমন পরিস্থিতির খবর নেয়নি কেউ।  

তাছলিমার মা বিবি কহিনুর বলেন, আমাদের বিধ্বস্ত ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। মেরামত করার মতো টাকাও নেই। আমরা কোথায় যাব? 

একই বাড়ির মুক্তা আক্তারও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দেন।  

মুক্তা বলেন, ঘরে তিনজন ছিলাম। আমার ফুফাতো বোন তার ছোট মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। পরিস্থিতি খারাপ থাকায় তাদর পাশের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেই। জলোচ্ছ্বাসের সময় আমরা ঘরেই ছিলাম। হঠাৎ জোয়ারের তোড়ে ঘরের মালামাল সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দুটা খাট ছিল, সেগুলোও নিয়ে গেছে। কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। একপর্যায়ে ঘরটিও মাটিতে পড়ে যায়। তার আগেই আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।

মুক্তা জানান, তাদের ঘরের সামনে থাকা আরও তিনটি ঘর পুরোপুরি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জলোচ্ছ্বাসের পানি।  

একই বাড়ির গৃহবধূ ইয়াছমিন তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে একটি বিধ্বস্ত ঘরে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে। জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে তাদের ঘরটি লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ঘরে বসবাস তো দূরের কথা, বসার মতো অবস্থাও রাখেনি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়।  

ইয়াছমিন বলেন, চুলোয় পানি, তাই রান্না করতে পারিনি। এজন্য দুপুরে খাওয়াও হয়নি। একজনের বাড়িতে চাল পাঠিয়েছি, সেখান থেকে রান্না করে দিয়েছে।

ইয়াছমিনের শ্বশুর ইউসুফ মাল বলেন, জলোচ্ছ্বাসে বসতঘরটি ভেঙে-চুরে দিয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসে দেখি ঘরের এমন খারাপ অবস্থা। স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি-নাতনিসহ ৬ জন লোক এ ঘরে থাকি। কিন্তু এখন তো আশ্রয়হীন হয়ে গেছি। গরিব মানুষ, কীভাবে ঘর মেরামত করি!

ওই বাড়ির বৃদ্ধা নারী কোহিনুর বেগম বলেন, আমাদের মাথার উপর ছায়া (ঘর) নেই। পেটে খাবারও নেই। আমাদের খবর কেউ লয় না।  

নদীর তীরের বাসিন্দা কৃষক মো. আলী বলেন, ঘরের পাশে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ ছিল। তাই প্রথমে ভেবেছি পানি ঢুকবে না। এজন্য আশ্রয়কেন্দ্রে যাইনি। কিন্তু বাঁধের মাটি ধসে গিয়ে বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। ঘরে বুক পরিমাণ পানি ছিল। প্রথমে ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে খাটের ওপর উঠে পড়ি। কিন্তু থাকার মতো অবস্থা ছিল না। তাই সাঁতরে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছি। বিকেল ৪টার দিকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই, এদিন ভোররাতে চলে আসি। বাড়িতে এসে দেখি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ঘরে থাকা চাল পানিতে ভিজে আছে।  

হালিমা নামে এক নারী বলেন, চুলায় পানি, রাঁধবো কীভাবে। ঘরের সব ভিজে গেছে। কিছু বাঁচাতে পারিনি। কোনটা রেখে কোনটা ধরবো- সেটা বুঝে ওঠার আগেই সব ভেসে গেছে।  

সফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ঘরে ছোট ছোট দুটা ছেলে-মেয়ে আছে। তাদের মা বেঁচে নেই। জলোচ্ছ্বাসের সময় তাদের নিয়ে ঘরেই ছিলাম। ঘরে বুক পরিমাণ পানি হয়ে গেছে। তাই কাঁধের ওপর দুই বাচ্চাকে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

তিনি আরও বলেন, ঘরে খাবার নেই। বাহির থেকে খাবার এনে খেয়েছি। কিন্তু কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।