ঢাকা: বাংলাদেশ পুলিশ প্রজাতন্ত্রের বাহিনী। এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত আইন কার্যকর, সম্পত্তি রক্ষা, সামাজিক অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি-২৫ (১)–এ বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনোভাবে যুক্ত হতে বা কোনো প্রকারে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা করতে পারবেন না। বিধি–২৫ (৩)–এ বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী আইন পরিষদ নির্বাচনে কোনো প্রকার প্রচারণা অথবা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব প্রয়োগ অথবা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যখন যে রাজনৈতিক দল সরকারে এসেছে তখন সেই সরকার পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। তারা নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। নিজেদের সুবিধার্থে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাহিনীর ভেতরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন সব আমলেই। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে সেই সরকারই পুলিশকে নিজেদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। আবার পুলিশের উর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও নিজেদের সুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতায় থাকা সরকারের হয়ে অধস্তনদের ব্যবহার করেছেন।
পুলিশে রাজনীতিকরণ শুরু হয়েছে বহু আগে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই রাজনীতিকরণ আগের চেয়ে বেশি হয়েছে। পুলিশের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের রাজনীতিকরণের মূলহোতা ছিলেন বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা প্রলয় কুমার জোয়ারদার। ২৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০০৯ সালে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে তিনি পুলিশ সদর দফতরে অ্যাডিশনাল এসপি হয়েও পুলিশ সুপার হিসেবে এআইজি আরএন্ডএম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার থাকার কারণে পুলিশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তার কথা ছাড়া পুলিশের কারও পদোন্নতি বা পদায়ন হতো না। তিনি বেছে বেছে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়নের ব্যবস্থা করতেন।
এর আগে কোহিনূর মিয়া নামেও এক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনিও পুলিশে দলীয় প্রভাব খাটাতেন বলে বিভিন্ন সময় খবরে উঠে আসে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে ও পরে সারাদেশে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা আহত হন। তবে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেলে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা আক্রমণের শিকার হন। থানায় থানায় হামলা হয়। অনেকে প্রাণও হারান। অনেক ব্যারাক ও স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অধস্তন কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ ঠেকানোর দায়িত্ব দিলেও সটকে পড়েন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ফলে কমান্ড ধরে বিক্ষোভ ঠেকাতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে আক্রান্ত হন মাঠের কর্মকর্তারা। আর নিরাপদে আত্মগোপনে চলে যান বড় কর্মকর্তারা।
এরপর ৫ আগস্ট রাতেই পুলিশের মধ্যে দেখা দেয় ক্ষোভ-অসন্তোষ। এই ক্ষোভ ও নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় তারা সমস্ত পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। তারপর থেকে ভেঙে পড়ে চেইন অব কমান্ড। এই সুযোগে স্বার্থান্বেষী ও সুযোগসন্ধানী চক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু করে লুটপাট, ডাকাতি ও রাহাজানি। পুলিশ সদস্যদের এই কর্মবিরতিতে গত দুদিন ধরে বিরাজ করছে অরাজক পরিস্থিতি।
রাজশাহীতে বিক্ষোভ
এর মধ্যে পুলিশ সদস্যদের হত্যার বিচারসহ নয় দফা দাবিতে রাজশাহীতে বিক্ষোভ হয়েছে বুধবার (৭ আগস্ট)। দুপুরে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে এই বিক্ষোভ হয়। এ সময় সবাইকে শান্ত করতে গিয়ে তাদের তোপের মুখে পড়েন রাজশাহীর বোয়ালিয়া জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) নূরে আলম সিদ্দিকী। পরে সেনা সদস্যরা তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন। এছাড়া একই দাবিতে রাজশাহীর সারদায় থাকা বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতেও বিক্ষোভ হয়।
রাজশাহী পুলিশ লাইনসে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, সরকারের যে পতন ঘটতে যাচ্ছে তা আগের দিনই টের পেয়েছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তখনই অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নিরাপদে চলে যান। অথচ সরকার পতনের দিনও শিক্ষার্থীদের দমন করতে সাধারণ পুলিশ সদস্যদের মাঠে নামানো হয়। এর ফলে থানায় ঢুকে ১৩ পুলিশকে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। তাই পুলিশ সদস্যদের এমন হতাহতের ঘটনার জন্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দায় রয়েছে বলে মনে করেন তারা। এ জন্য তারা ‘দায়িত্বহীন’ পুলিশ কর্মকর্তাদেরও বিচার চান। পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশ অধস্তন কর্মচারী সংগঠন যে ৯ দফা দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেছে, তা বাস্তবায়নের দাবি জানান। বিক্ষোভ থেকে আরএমপি কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সমালোচনা করা হয়।
এ সময় সেখানে গিয়ে রাজশাহীর বোয়ালিয়া জোনের উপ-কমিশনার নূরে আলম সিদ্দিকী বিক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। আর তাদের দাবির প্রতিফলন আগামী ২/৩ দিনের মধ্যেই ঘটবে বলেও পুলিশ সদস্যদের আশ্বস্ত করেন।
তবে এ সময় পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ নূরে আলম সিদ্দিকীকে আরএমপি ‘কমিশনারের দালাল’ আখ্যা দিয়ে শোরগোল শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি পুলিশ সদস্যদের তোপের মুখে পড়লে পুলিশ লাইনসের প্রধান ফটকে দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা ছুটে যান। তারা তাকে সেখান থেকে কোনো রকমে উদ্ধার করেন।
একই দাবিতে রাজশাহীর সারদায় থাকা বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতেও আজ বিক্ষোভ করেন পুলিশ সদস্যরা। কর্মবিরতি দিয়ে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পুলিশ একাডেমির ভেতরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন বিক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যরা। এ সময় আশপাশের এলাকায় অন্যরকম এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
যদিও বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ফারুক আহম্মেদ জানিয়েছেন, ওই সময় আসলে বিক্ষোভ নয়, তারা কিছু কথা বলেছেন। পরে আবার ফিরেও গেছেন।
আন্দোলন ঝিনাইদহেও
বুধবার সন্ধ্যায় ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনসেও বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন সেখানে কর্মরত তিন শতাধিক পুলিশ সদস্য। এতে পুলিশ সুপার আজিম উল আহসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। বাংলাদেশ পুলিশ কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের অধীনে কাজ করবে না, নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের জনগণের সেবা তথা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে তারা এ সময় উল্লেখ করেন।
৯ দফা দাবি
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে সারাদেশে পুলিশ সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা, পুলিশ সদস্য খুনসহ স্থাপনা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রায় ৪৫০টি থানা আক্রমণ করে অগণিত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ ‘পুলিশ অধস্তন কর্মচারী সংগঠন’ ৬ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করছে। দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একসঙ্গে মিলে একসঙ্গে কাজ করতে চেয়ে ৯ দফা দাবি দেয় তারা। দাবিগুলো হলো—
১. সব পুলিশ সদস্য হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ২. নিহত পরিবারের ক্ষতিপূরণসহ সেই পরিবারের ন্যূনতম একজন সদস্যকে সমপদে নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. আহত সকল পুলিশ সদস্যের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করা। ৪. আট ঘণ্টার বেশি ডিউটি পালনে বাধ্য না করা। এর বেশি ডিউটি পালনে ওভার ডিউটির সুবিধা দেওয়া। ৫. শুক্রবার, শনিবারসহ সকল সরকারি ছুটি ভোগের সুযোগ প্রদান। দেশের স্বার্থে/জনগণের স্বার্থে ছুটি ছাড়তে না পারলে অতিরিক্ত কর্মদিবস হিসাবে আর্থিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। ৬. উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশ দানে সংবিধান ও জনগণের মনের কাঙ্ক্ষিত বিষয় প্রাধান্য দেওয়া। ৭. পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে শুরু করে সকল মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিস, পুলিশ লাইন্স, পুলিশ হাসপাতাল, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, ক্যাম্পের নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করে নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা। ৮. যথাসময়ে সকল পদে পদোন্নতির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বৈষম্য দূর করা ও বদলির আদেশ দানে নিজ জেলার নিকটবর্তী জেলার প্রাধান্য নিশ্চিত করা। ৯. বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা রক্ষায় পুলিশ সংস্কার আইন প্রণয়ন করা। যেন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দ্রুততম সময়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে বর্তমানে পুলিশের ফোকাল পারসন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, পুলিশের চেইন অব কমান্ডের বা কমান্ড লেভেলে যারা আছেন তাদের কাজকর্মে কোনো গাফিলতি থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নতুন আইজিপি নিয়োগ
এদিকে বর্তমান সংকটকালে ৬ আগস্ট রাতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পুলিশের ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের কমান্ড্যান্ট (অতিরিক্ত আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলামকে। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে মঙ্গলবার রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে নতুন আইজিপি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বুধবার (৭ আগস্ট) বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান কার্যনিবাহী কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন কমিটির সভাপতি করা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক মো. আব্দুল্লাহেল বাকী ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে দাউদ হোসেনকে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০২৪
এসজেএ/এসএস/এইচএ/