ঢাকা, রবিবার, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩১, ১১ আগস্ট ২০২৪, ০৫ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পোশাকশ্রমিকদের ১১ দাবি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পোশাকশ্রমিকদের ১১ দাবি

ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা এবং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সকল দমনমূলক মামলা প্রত্যাহারসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি।

রোববার (১১ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবের মানিক মিয়া হলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে পোশাকশ্রমিকের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় ও আলোচনা সভায় এসব দাবি উত্থাপন করা হয়।

মতবিনিময় সভার শুরুতে লিখিত বক্তব্য ও খসড়া ১১ দাবিনামা উত্থাপন করেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার। সভায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে সাভারে নিহত পোশাকশ্রমিক শুভ শীলের মা, যিনি নিজেও পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিক সাধনা শীল বক্তব্য রাখেন। বাবুল হোসেনের পরিচালনায় শ্রমিকনেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অঞ্জন দাস, সাদেকুর রহমান শামীম, রাজু আহমেদ, প্রকাশ দত্ত ও আলীফ দেওয়ান। এছাড়া পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আকলিমা আক্তার।

মতবিনিময়ে শ্রমিক নেতাদের পাশাপাশি কথা বক্তব্য রাখেন গবেষক বিআইজিডি মাহীন সুলতান, লেখক শিবিরের সভাপতি ও বুয়েটের অধ্যাপক আব্দুল হাসিব চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা আবুল হাসান রুবেল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নাভিন মুরশিদ, নারী পক্ষের আফসানা সেহেরী, অভিনেতা-নাট্যকর্মী ঋতু সাত্তার ও আলোকচিত্রী আমিরুল রাজীব। সভার শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

বক্তারা বলেন, বিগত সময়ে স্বৈরশাসকের নজরদারি সবচেয়ে বেশি ছিল শ্রমিকের ওপর। শ্রমিকরা যাতে আন্দোলন না করে তার জন্য ছিল সব আয়োজন। ২০২৩ সালের মজুরি আন্দোলন দমন করতে শত শত শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়, যা আন্দোলন দমনের কৌশল ছাড়া কিছুই ছিল না। তাই বাকস্বাধীনতা ও সংগঠনের অধিকারের এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা দরকার, যাতে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে শ্রমিকরা কথা বলতে পারেন এবং দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগঠিত হতে পারেন। দ্রুত শ্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে করা দমনমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য দাবি জানান বক্তারা।

সরকারে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব দাবির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন বক্তারা। অন্যান্য দাবির সঙ্গেও সংহতি জ্ঞাপন করেন। বক্তারা আরও বলেন, ১১ দফার সাথে রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডে দোষী সোহেল রানাসহ দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা এবং রানা প্লাজার সামনে স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির আহ্বান যুক্ত থাকা দরকার।

সামাজিক সুরক্ষা খাতে শ্রমিকদের বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়ে আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, এই বাংলাদেশে নতুনভাবে গড়তে হবে এবং প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিক এলাকাকে ভয় ও প্রলোভন থেকে মুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার আহবান জানান তারা।

মতবিনিময় সভায় উত্থাপিত ১১ দাবি হলো-
১) শহীদ গার্মেন্ট শ্রমিক শুভ শীল-সহ ৬ শ্রমিক এবং সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। শহীদ পোশাক শ্রমিকসহ সকলকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিতে হবে। তাঁদের পরিবারকে মর্যদাপূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। একই সঙ্গে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে।

২) আন্দোলনকালে করা সকল দমনমূলক মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিতে সরকারকে ভূমিকা রাখার দাবি জানাই। ২০২৩ মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে ৪ শ্রমিক হত্যার বিচার ও শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকদের ওপর করা দমনমূলক সকল মিথ্যা মামলা নির্বাহী আদেশে প্রত্যাহার সরকারের দ্রুত ভূমিকা প্রত্যাশা করি। একইসাথে এ আন্দোলনে আরব আমিরাতে প্রবাসী ৫৭ জন শ্রমিকের কারাগার থেকে মুক্ত করার বিষয় সরকারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই।

৩) শ্রমিক স্বার্থের পক্ষের প্রকৃত প্রতিনিধি নিয়ে নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে নতুন করে গঠন ও ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবির প্রেক্ষিতে পুনর্বিবেচনায় জন্য আহ্বান জানাই। এবং দেশে জাতীয় ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপনে অর্ন্তবর্তী সরকারের বিশেষ ভূমিকা প্রত্যাশা করি।

৪) পোশাকশ্রমিকসহ শ্রমজীবীদের রেশনিং দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। রেশনিং ব্যবস্থা বা ফ্যামিলি কার্ড বণ্টন যাতে কোনো দলীয় ক্ষমতার ব্যবহারে না হয়, তার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা তৈরি করতে হবে।

৫) শ্রমিক এলাকাকে ভয়হীন-প্রলোভনহীন দূষিত পরিবেশ থেকে মুক্ত করে প্রাণচঞ্চল করতে মনোযোগী হতে হবে। সংগঠন, ইউনিয়ন, মিছিল-মিটিং-সভা করার অধিকার এবং মতপ্রকাশে স্বাধীনতা নিশ্চিতে করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখা যাবে না। মালিক স্বার্থে নয়, শ্রমিক স্বার্থে  প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের আইন ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ইপিজেড এবং ইপিজেড-এর বাইরে দুই রকম শ্রম আইনের বিধান বাতিল করতে হবে।

৬) শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য যথাযথ দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগী হতে হবে। বেতন-সহ মাতৃত্বকালিন ছুটি ৪ নয়, ৬ মাস করতে হবে। কারখানায় যথাযথ যৌননিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল গঠনে শ্রমিক সংগঠন, প্রকৃত সৎ শ্রমিক প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ-সহ সকল অংশীজনকে নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে।

৭) শিল্প কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চিতে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক প্রতিনিধিসহ জাতীয় কমিশন গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। কলকারখানা পরিদর্শন দপ্তর এবং বিজিএমইএ-সহ এই খাত সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী বা মালিকদের উদ্যোগে গঠিত সকল প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৮) গার্মেন্ট শ্রমিকদের আবাসন, তাদের জন্য স্বাস্থ্য-সেবা, সন্তানদের শিক্ষার পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য ন্যয়সঙ্গত অবসর ভাতা নিশ্চিতকরণের জন্য জাতীয় পর্যায়ের নীতি-সংলাপ শুরু করতে হবে।

৯) মর্যাদাপূর্ণ ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানদণ্ড অনুসরণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। জরুরি তহবিল গঠনে মালিক-সরকার বায়ার ৩ পক্ষকে যুক্ত করতে হবে। সরকারের শ্রমিককল্যাণ ফান্ডে মালিক-সরকার ও বায়ার ৩ পক্ষকে অংশ নিতে হবে।

১০) গার্মেন্ট পণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতা তথা ‘বায়ার’দের সাথে দর-কষাকষির দক্ষতা বাড়াতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরকারের যৌথ উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে। মালিকদের পাশাপাশি বায়ারদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

১১) হয়রানিমূলক ‘ব্ল্যাক লিস্টিং’ বা কালো তালিকা করা বন্ধ এবং শ্রম দপ্তরের তদারকিতে শ্রমিকদের ডাটাবেজ কার ও হালনাগাদ করতে হবে। প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে হবে যার রেকর্ড শ্রম অধিদপ্তরে রাখতে হবে। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।