সাভার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আন্দোলনকারী জনতাকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যার দায়ে ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও তৌহিদ জং মুরাদসহ ১১৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছেন নিহত আস-সাবুরের চাচাতো ভাই পরিচয়ে সাহিদ হাসান ওরফে মিঠু। তবে নিহতের মায়ের দাবি সাহিদ হাসান ওরফে মিঠুকে তিনি কখনও দেখেননি।
সোমবার (১৯ আগস্ট) সকালে আস-সাবুরের মা মোছা. রাহেন জান্নাত ফেরদৌসী বাংলানিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে গত শুক্রবার (১৬ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টার দিকে মামলাটি দায়ের করেন নিহত আস-সাবুরের প্রতিবেশী চাচাতো ভাই সাহিদ হাসান ওরফে মিঠু। কিন্তু মামলাটি ভুয়া বলে আরেকটি মামলা দায়ের করেন আস সাবুরের মা মোছা. রাহেন জান্নাত ফেরদৌসী। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪০ জন।
নিহত আস-সাবুর (১৬) নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার মহাদেবপুর গ্রামের নায়েদ ওরফে জাকিরের ছেলে। সে আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের জামগড়ার শিমুলতলার এলাকায় পরিবারের সাথে ভাড়া থেকে জামগড়া শাহীন স্কুলের ১০ দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো।
নতুন মামলায় আসামি করা হয়েছে- ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডেন্ডাবর এলাকার মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৫৫), আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইয়ারপুর ইউনিয়নের গনি কুলুর ছেলে তুহিন কুলু (৫৪), আশুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ওহাব মাদবরের ছেলে সাহাব উদ্দিন মাদবর (৫৮), ইয়ারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামীম আহাম্মেদ সুমন ওরফে সুমন ভূইয়া (৫০), আশুলিয়া থানা যুবলীগের আহবায়ক মো. কবির সরকার (৫২)। এছাড়া শাকিল মুন্সী উকিল (৩৮), মো. এনামুল হক মুন্সী (৪৭), সাদেক ভূইয়া (৬০), সাইফুল ইসলাম বেপারী হিকু (৫৭), রাজু দেওয়ান (৪৫), মজিবুর রহামান (চুরা মজিবুর) (৫২), মুশাররফ হোসেন (মুসা) (৫১), হাসান কবির (৫৫), মিলন মীর (৫০), আরিফ মাদবর (৪৫), শাহাদাত মুন্সী (২৯), সানি ভূইয়া (৪৫), উজ্জ্বল ভূইয়া (৩৫), মো. আশরাফ উদ্দিন মাতবর (৫৭), হেলাল মাতবর (চেয়ারম্যান) (৫৫), ইমতিয়াজ দেওয়ান (৫০), আশরাফ (৪৫), সাইদুর রহমান সম্রাট (৩২), আলী (৪৫), ইয়াকুব মাতবর (৪০), আবুল হোসেন ভুইয়া (৩২), সাইফুল ইসলাম রানা (৩০), মো. মাসুম মুন্সী (৪০), ইদ্রিস আলী (৩০), তালহা ভুইয়া (২৭), সফর শেখ (৪৭), ফরিদ মন্ডল (৫২), ইয়াছিন আরাফাত পাপ্পু (২৮), রুবেল ভুইয়া (জামাই) (৩৫), মো. খলিল প্রধান (৪৫), শেখ শাহজালাল শাওন (৩৭), কাব্য ভূইয়া (২৮), আলম ভূইয়া (৫৫), ফারুক ভূইয়া (৫৫), বশির ভূইয়াকে (৪৭) আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিতে বাইপাইলে যায় সাবুর। ওই দিন বিকেল তিনটার দিকে তার সাথে কথা হয় মায়ের। এর পর থেকে তার সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পর দিন বিকেল ৫টার দিকে সাবুরের মরদেহ পড়ে থাকার খবর পেয়ে বাইপাইল মোড় থেকে সেটি উদ্ধার করে গ্রামের বাড়ি নওগাঁ নিয়ে তাকে দাফন করে পরিবার।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, বাদী খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন ঘটনার দিন ১ থেকে দেড় হাজার বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারী বাইপাইল মোড়ে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আস-সাবুর বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এ সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীরাসহ অজ্ঞাতনামা আরও আসামিরা দেশি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীসহ যাকে সামনে পায় তাকেই এলোপাতাড়ি পিটায় ও গুলি করে। আসামিদের মারপিট ও গুলিতে আস-সাবুর ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আসামিরা পরস্পরের যোগাযোগসাজশে সাবুরকে গণহারে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে পরের দিন খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে গ্রামের বাড়ি মহাদেবপুর বাস স্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এদিকে আগের মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন বেলা ১১টার দিকে আস-সাবুর নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করার জন্য তার ভাড়া বাসা শিমুলতলা থেকে বাইপাইলে যায়। পরে দুপুর ২টার দিকে মামলার বাদী খবর পান তার ভাই আস-সাবুর মৃত অবস্থায় বাইপাইল মোড়ে পড়ে আছে। খবর পেয়ে লোকজন নিয়ে বাইপাইল মোড়ে গিয়ে তিনি দেখেন তার ভাইয়ের ক্ষত-বিক্ষত নিথর মরদেহ পড়ে আছে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীরা তাকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মামলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর আগে থেকে বিদেশে থাকা ও বিএনপির বেশ কয়েকজনসহ ১১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে সাহিদ হাসান ওরফে মিঠুর মোবাইলে কল করা হলেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। মেসেজ দিলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
নিহত আস-সাবুরের মা মোছা. রাহেন জান্নাত ফেরদৌসী বাংলানিউজকে বলেন, আমি আমার ছেলের মরদেহ উদ্ধার করে গ্রামে নিয়ে দাফন করি। হঠাৎ টিভির খবরে দেখতে পাই মিঠু নামের একজন আমার ছেলে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন। আমি অনেক কষ্টে মিঠুর ফোন নম্বর সংগ্রহ করে সকাল থেকে কল করি। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। সন্ধ্যা সাতটায় আবার কল করলে তার সঙ্গে আমার কথা হয়।
তিনি সাবুরের কেমন ভাই প্রশ্ন করলে মিঠু কোনো উত্তর দেননি। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা না বলে আমতা আমতা করেন। তিনি আমাকে আপা সম্বোধন করেন। সাবুর ভাই হলে আমাকে আপা সম্বোধন করছেন কেন? আমি তো সাবুরের মা এমন প্রশ্ন করলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
সাবুরের মা বলেন, আমার মৃত ছেলেটাকে নিয়ে একটি পক্ষ নোংরা খেলায় মেতেছে। আমি এই মিঠুকে আমার সামনে দেখতে চাই। কেন সে আমার ছেলের ভাই পরিচয় দিয়ে মামলা করলেন আমি জানতে চাই।
এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) এএফএম সায়েদ বাংলানিউজকে বলেন, একটি মামলা দায়ের করেছেন নিহত আস-সাবুরের মা মোছা. রাহেন জান্নাত ফেরদৌসী। এর আগেও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। যদি দ্বিতীয় বাদীর অভিযোগ সঠিক হয় তাহলে আগের মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে গত ৪ ও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের হামলায় সাভারে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন অনেকেই। গত ৭ আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬ জন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০২৪
এমজে