ঢাকা, শনিবার, ৯ ভাদ্র ১৪৩১, ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১৮ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

লক্ষ্মীপুরের চারিদিকে শুধু অথৈ পানি

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০২৪
লক্ষ্মীপুরের চারিদিকে শুধু অথৈ পানি বন্যা, লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার জকসিন থেকে ভবানীগঞ্জ সড়কের বেশির ভাগ অংশ এখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সড়কের উত্তর অংশটি পড়েছে লাহারকান্দি ইউনিয়নের মধ্যে।

উঁচু এ সড়কটি তলিয়ে যাওয়ায় সড়কের দুইপাশের বাসিন্দারা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। পাশের মান্দারী ইউনিয়নে যাদৈয়া এবং মোহাম্মদনগর গ্রামও অথৈ পানিতে তলিয়ে গেছে।

এসব এলাকায় প্রায় সবগুলো বসতবাড়িই পানির নিচে। যাদের বসতভিটা নীচু, তাদের ঘরে হাঁটুপানি। বাড়ির উঠোনে কোমর পানি। পানিতে নিমজ্জিত টিউবওয়েল এবং শৌচাগার।

ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। সেইসঙ্গে বিশুদ্ধ পানির অভাব। এক দুর্বিষহ জীবন পার করতে দেখা গেছে ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের।

যাদের বসতঘরে থাকার মতো পরিস্থিতি নেই, তারা উপায়ন্তর না পেয়ে উঠেছেন পার্শ্ববর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে। আবার কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

শনিবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে সদর উপজেলার মান্দারী এবং লাহারকান্দি ইউনিয়ন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

লাহারকান্দি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বৃদ্ধ কাশেম ও রৌশন দম্পতি। সড়কের পাশেই তাদের বসতবাড়ি। তাদের ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি। বাড়ির উঠোনে কোমর পানি। ঘরের দরজার সামনে বসেই কাপড়চোপড় ধোঁয়া, হাঁড়ি পাতিল পরিষ্কারের কাজ করতে পারেন।

বৃদ্ধা কাশেম জানান, ঘরে আট জন সদস্য তাদের। এদের মধ্যে চারজনই শিশু। ঘরের মেঝেতে পানি, তাই শিশুদের নিয়ে ভয় কাজ করে।  

একদিকে শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন, অন্যদিকে রান্না বান্না নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।

তিনি জানান, চারিদিকে অথৈ পানির কারণে মাটির চুলোয় রান্না পুরোপুরি বন্ধ। ঘরে গ্যাসের সিলিন্ডারে রান্নার কাজ সারতে হয়।

এদিকে যাদের সিলিন্ডার নেই, তাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।

তাদের একজন গৃহবধূ কহিনুর বেগম। ঘরে চাল থাকলেও রান্না করতে পারছেন না। গ্যাসের সিলিন্ডার নেই। মাটির চুলা গত তিনদিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে।

পাশের বাড়ির বৃদ্ধ রুহুল আমিন। পেশায় জকসিন বাজারে ফুটপাতের চা দোকানদার। বাজারে প্রতিদিন চারবার যাতায়াত করতে হয় তাকে। কিন্তু বাড়ির উঠোন থেকে রাস্তা পর্যন্ত কোমর পানি, আর রাস্তায় হাঁটু পানি। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাকে।

রুহুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পুরো বাড়িই পানিতে তলিয়ে গেছে। সবার ঘরেই কমবেশি পানি। গত তিনদিন ধরে পানির উচ্চতা বেড়েছে। এর আগে প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আমরা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে আছি।

ওই বাড়িতে দেখা যায় লিজা বেগম নামে এক নারী তাদের বসতঘরের মালামাল গুছিয়ে আরেক বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। বসত ঘরে ঢুকে দেখা গেছে- হাঁটু পরিমাণ পানি। খাটের কাছাকাছি পানি উঠে গেছে। আশপাশের টিউবওয়েল, রান্না ঘর, শৌচাগারও তলিয়ে গেছে পানির নিচে।

লিজা বলেন, ঘরে এখন আর বসবাসের মতো পরিস্থিতি নেই। তাই আজ থেকে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।

এদিকে যাদের কোথাও আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই, তাদের বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে পানির মধ্যেই। এদের একজন বিধবা নারী বুলি বেগম। ঘরের মধ্যে পানি। চুলাও পানিতে তলিয়ে আছে। ১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে এখন মানবেতর জীবন পার করছেন তিনি। ঘরে উপার্জনক্ষম লোক নেই, তাই তেমন কোনো খাবার নেই। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার পেয়েছেন, সেগুলো দিয়েই কোনোভাবে চালিয়ে দিচ্ছেন।

বুলি বেগম বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তাই বসতঘর ছেড়ে যেতে চাই না।

একই বাড়ির মো. আলম ও বাবুল বলেন, চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। বাড়িতে পানি, বসতঘরেও পানি, রাস্তায় পানি। খুব কষ্টে বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের।

লাহারকান্দি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মুকিতুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ১ নম্বর ওয়ার্ডটি নীচু হওয়ায় পানিতে তলিয়ে গেছে। বেশিরভাগ ঘরে পানি ঢুকেছে। মানুষ কষ্টে আছে। কিন্তু সরকারিভাবে আমরা কোনো ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছি না। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কিছু ত্রাণ পেয়েছি। তাই সরকারি ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।  

লাহারকান্দি ইউনিয়নের চাঁদখালী গ্রাম এবং মান্দারীর যাদৈয়া ও মোহাম্মদনগর গ্রামে গিয়েও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে সবগুলো গ্রাম। চলাচলের রাস্তাতেও কোমর পরিমাণ পানি। সড়কে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। সড়কের ওপর থেকে জাল ফেলে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে গ্রামের পুরুষ লোকজনদের।

আর ওইসব গ্রামের গৃহবধূরা বাড়িতে আটকা পড়েছেন শিশু সন্তান নিয়ে।

যাদৈয়া গ্রামের নুর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ঘরের চারপাশে পানি। পানির উচ্চতা বাড়তেছে।  যেকোনো সময় ঘরে ঢুকতে পারে। তখন শিশুদের নিয়ে ঘরে থাকা অনিরাপদ হয়ে যাবে৷ স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিতে হবে।

যাদৈয়া খায়রুল এনাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে হাঁটুর ওপর পানি। বিকেলে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন নারী, পুরুষ ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে। আর বিদ্যালয়ের নিচে রাখা হয়েছে গবাদিপশু।

আশ্রয় নেওয়া গৃহবধূ ফেন্সি বেগম বলেন, বিদ্যালয়ের পেছনেই আমাদের বাড়ি। ঘরের ভেতর কোমর পানি। তাই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের বাড়ির চার পরিবারসহ এখানে সাতটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তবে আশ্রয় নেওয়া এসব লোকজনের সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে খাবার পানি নিয়ে আসতে হয়।

লক্ষ্মীপুরের বন্যার সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়ার সঙ্গে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলে পানি বেড়েছে। নোয়াখালীর বন্যার পানি বেগমগঞ্জ হয়ে এসব এলাকায় ঢুকে পড়ছে। তবে মেঘনা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে আছে। ভাটার সময় স্লুইস গেট দিয়ে পানি বের হচ্ছে। আশাকরি পানি নামতে থাকলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে।

তিনি জানান, বন্যার্তদের জন্য জেলার ১৮৬টি স্থায়ী এবং ৬০টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শনিবার পর্যন্ত ৮ হাজার ৫৫০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।