লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় গত দুই সপ্তাহ ধরে চলছে বন্যা। এর আগে ভারী বৃষ্টিপাতে আরও প্রায় ১০ দিনের বেশি সময় ধরেছিল ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
এতে দেখা যায়, জেলার কোথাও এক মাসের বেশি সময় ধরে লোকজন পানিবন্দি হয়ে সীমাহীন কষ্টে বসবাস করছে। জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, আট লাখের বেশি লোকজন পানিবন্দিতে ছিল। এখনো পানিবন্দি প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ।
লক্ষ্মীপুর মেঘনা নদীর উপকূলীয় জেলা। সচরাচর এ জেলাতে বন্যা হয় না। সর্বশেষ ২০২৪, এর আগে ১৯৯৮, তার আগে ১৯৮৮ সালে বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। সে সময়ের বন্যার পানির উচ্চতা এখানকার চেয়ে আরও বেশি হলেও দীর্ঘ মেয়াদি ছিল না। এবার বন্যার স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়েছে।
সাধারণত বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় এ জেলায় পানি বিভিন্ন খাল হয়ে মেঘনায় গিয়ে পড়ে। সেখান থেকে বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবে এবারের জলাবদ্ধতার সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল যোগ হয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি প্রবাহ না থাকায় এবারের বন্যা আগের বন্যার চেয়েও দীর্ঘ মেয়াদি হয়েছে। ফলে অতীতের ভোগান্তির থেকেও এবারের ভোগান্তির চিত্রও বেশি। আর ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক আকারে।
দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পেছনে খালে পানি প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন।
আর পানি প্রবাহ কমার পেছনে খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, খালের গভীরতা কমে যাওয়া, খালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, খালের ওপর অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে।
গত কয়েকদিনে বন্যাকবলিত এলাকা, মেঘনা নদীর তীর পরিদর্শন এবং বন্যার্ত বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যের মিল পাওয়া গেছে।
মানব সৃষ্ট এসব বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ঠিক এ মুহূর্তে দূর করাও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে নামছে না বন্যার পানি। এতে দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতি।
লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে দেখা গেছে, নদীর পানি পাড় থেকে ৮-১০ ফুট নিচে। মেঘনাপাড়ের বহু এলাকায় ফসলি জমিতে এখন পানি নেই। এর পুরো বিপরীত চিত্র একটু দূরে শুধু পানি আর পানি। মেঘনা নদী থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও সদর উপজেলা হয়ে ছুটে আসা ভুলুয়া নদ এসে মিশেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ওয়াপদা খালে। অন্য অংশ ছুটে গেছে নোয়াখালীর ভেতরে। ৭৬ কিলোমিটার এ নদের প্রতি ১শ ফুটে রয়েছে মাছ ধরার একটি করে জাল কিংবা একটি ডুবন্ত বাঁধ, বাড়ির পথ, ইটভাটার রাস্তা, নীচু ব্রিজ।
নানা প্রজাতির এ জাল ও বাঁধে পানি কোনোভাবেই নড়ছে না। রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের কোডেক বাজার থেকে আজাদনগর এলাকায় কয়েকজন ভূমি দস্যু ভুলুয়া দখল করে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। সে জমিতে ঘর-বাড়ি তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া ভুলুয়ার তীরে মাছের ঘের, মুরগির খামার এবং খোদ ভুলুয়ার ভেতরের অংশে পাড় বাঁধিয়ে পুকুরও বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
ভুলুয়া তীরের রামগতি অঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, এক সময়ের ৫শ মিটার চওড়া ভুলুয়া এখানে এসে হয়ে গেছে ৩০ ফুট। ফলে ৭৬ কিলোমিটার দূরের পানি এই ৩০ ফুট অগভীর পথ দিয়ে বের হচ্ছে না। যার কারণে জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট জুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্ট বন্যায় ডুবে আছে ভুলুয়া পাড়ের কয়েক লাখ মানুষ।
তারা জানায়, এ বন্যা আর কতদিন থাকবে, তার কোনো হিসেব নেই। পানি ঠিকমতো নামছে না। তাই বন্যার উন্নতি দেখছে না তারা।
লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের পূর্ব পাশের ভবানীগঞ্জ থেকে তোরাবগঞ্জ বাজার পর্যন্ত সড়ক পাশ দিয়ে মুছার খালের এক মাথা গেছে ওয়াপদা খালে, অন্য মাথা মেঘনা নদীতে। প্রায় ১শ ফুট চওড়া খালটির ওপর চর মনসা এলাকায় আশপাশের কয়েকটি ইটভাটা বড় বড় রাস্তা তৈরি করে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে খাল। ফলে পূর্বপাড়ের কয়েক হাজার একর জমির ফসল ডুবে গেছে। হাজার হাজার বাসিন্দা এখন এক মাসের বেশি সময় ধরে পানিবন্দি।
লক্ষ্মীপুরের আরেকটি ছোট নদী ডাকাতিয়া। কুমিল্লা থেকে আঁকাবাঁকা পথে চাঁদপুর ও নোয়াখালী হয়ে এসে পৌঁছেছে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। উপজেলার হাজিমারা স্লুইস গেট হয়ে ডাকাতিয়ার পানি পড়ে মেঘনা নদীতে।
স্থানীয় বাসিন্দা আজম খান ও আবদুর রহমান সুমন জানান, রায়পুর বাজার থেকে ডুবন্ত ও দৃশ্যমান শত শত বাঁধে আটকে গেছে ডাকাতিয়া। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীটি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে মোটা জাল আর কচুরিপানার বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করেছে। ডাকাতিয়ার কয়েক কিলোমিটারে এখন স্রোত নেই। ফলে ডুবছে রায়পুরের মানুষ।
রায়পুরের বাসিন্দা ওয়াহিদুর রহমান বলেন, গত ৪০ বছরেও ডাকাতিয়ায় কোনো ড্রেজিং হয়নি। ফলে গভীরতা কমেছে।
দক্ষিণ চরবংশী এলাকার বাসিন্দা শরীফ হোসেন বলেন, তাদের এলাকার মোল্লার হাট বাজার সংলগ্ন মেঘনা নদীর সংযোগ যে খালগুলো রয়েছে, এর একাধিক স্থানে সম্প্রতি ভরাট করে চলাচলের পথ তৈরি করা হয়েছে। ফলে উত্তর অংশের পানি দক্ষিণের মেঘনা নদীতে পড়তে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি হয়ে পশ্চিমের ডাকাতিয়া নদীতে পানি প্রবাহের একমাত্র খালের নাম বিরেন্দ্র খাল। রামগঞ্জ উপজেলা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ খালে শত শত টন আবর্জনায় সোনাইমুড়ির পানি ডাকাতিয়ায় যেতে পারছে না। এ খাল এখন কার্যত বন্ধ। ফলে এক মাসের বেশি সময় জলাবদ্ধতা থেকে এখন বন্যায় ভাসছে রামগঞ্জ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। তবে স্থানীয়দের উদ্যোগে ওই খালের কয়েকটি স্থান পরিষ্কার করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পানি নিষ্কাশন হয় রহমতখালী খাল ও ওয়াপদা খাল দিয়ে। আবার নোয়াখালী ও ফেনী জেলার পানি প্রবাহিত হয় এ দুটি খাল দিয়ে। জেলার মজুচৌধুরীর হাটে থাকা দুটি স্লুইস গেট দিয়ে পানি নামে এ দুটি খালের। স্লুইস গেট দিয়ে যে পরিমাণ পানি নিষ্কাশনের ধারণক্ষমতা আছে, তার চেয়েও কম পানি নিষ্কাশন হতে দেখা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকেও একই তথ্য পাওয়া গেছে।
রহমতখালী খালের উৎপত্তি ফেনী জেলা থেকে। নোয়াখালী জেলা হয়ে বেগমগঞ্জ উপজেলা এবং লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ হয়ে ১৩৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ খালটি লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। ভারত থেকে নেমে আসা বন্যার পানি ফেনী ও নোয়াখালী হয়ে রহমতখালী খাল হয়ে আসে লক্ষ্মীপুরে দিকে।
ফেনী থেকে তীব্র স্রোত নিয়ে বন্যার পানি এ অঞ্চলে নেমে এসেছে, তা আর মেঘনায় পড়তে পারেনি। দখলে-দূষণে রহমত খালটি পুরোনো অস্তিত্ব হারানোর ফলে বন্যার পানি ধারণ করার মতো উপযুক্ত নয়৷ ফলে এ পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্বাংশের চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, উত্তর জয়পুর, হাজিরপাড়া, মান্দারী, দত্তপাড়া, বশিকপুর, দিঘলী, তেওয়ারীগঞ্জ লাহারকান্দি, বাঙ্গাখাঁ, পার্বতীনগর ও পৌর এলাকায়। দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা।
রহমতখালী খালে পানি প্রবাহ না থাকায় এ পানি এখন আর নামছে না। ছড়িয়ে পড়া পানি আটকা পড়েছে।
রহমতখালী খাল থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট-বড় বেশ কিছু খাল রয়েছে। এর অনেকগুলোর এখন আর অস্তিত্ব নেই। লোকজন খালের ওপর চলাচলের রাস্তা তৈরি করে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কোথাও কোথাও মাছ শিকারের বেল জাল বসিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে।
ওয়াপদা খালে পানি প্রবাহের গতি থাকলেও রহমত খালীতে পানি প্রবাহ অনেকটা বন্ধ।
লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী সড়কের মান্দারি একটি বড় বাজার। বাজারের পূর্ব দিকে রহমতখালী খালের সঙ্গে মিলেছে মান্দারি-মোল্লারহাট খাল। খালটির মুখ থেকে বাজারের প্রায় ৫শ মিটারের মধ্যে এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। ময়লা আবর্জনাতে ভরপুর খালটি।
মান্দারী পূর্ব বাজার হয়ে দক্ষিণ দিকে দিঘলীর ওয়াপদা খাল পর্যন্ত একটি সংযোগ খাল এবং মধ্য বাজার হয়ে আমিন বাজার সড়কের পূর্ব পাশ দিয়ে দক্ষিণমুখী একটি সংযোগ খাল ওয়াপদা খালে গিয়ে পড়েছে। এ দুটি সংযোগ খালের মান্দারী বাজার অংশ ভরাট হয়ে আছে। মাছ শিকারের বেল জাল বসিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে কোথাও।
রহমতখালী খাল পূর্ব দিক থেকে এসে মান্দারী বাজারের ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে মোড় নিয়ে আবার পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু মান্দারী বাজার অংশে এ খালের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দুইপাশ দখল করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করায় খালটি নালায় পরিণত হয়েছে। আর বাজারের সব ময়লা-আবর্জনা ফেলে পুরোপুরি ভরাট করা হয়েছে। ফলে এ অংশে এখন আর পানি প্রবাহ নেই।
খালগুলোর পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পেছনে বড় আরেকটি বাঁধা অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ভুলুয়া খালের ওপর একটি সুরু সেতু। সেতুটির স্প্যান (বীম) পানির লেভেল থেকে প্রায় ৬ ফুট নিচে। সেখান থেকে ৩-৪ ফুট নিচে মাটি। ফলে এ সেতুটি নিজেই ভুলুয়ার পানি প্রবাহে বাধা দিচ্ছে। সদর উপজেলার মুছার খাল থেকে সরু একটি খাল ছুটে গেছে মেঘনা নদীতে। এক মাথার নাম ছরিখাল এবং অন্য মাথার নাম ভুট্টোরখাল। কমলনগরের চর লরেঞ্চ গ্রামের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেছে বিভিন্ন বাড়ির পথের জন্য অনেকেই কালভার্ট তৈরি করেছে। ৩০ ফুট চওড়া খালটিতে প্রতিটি কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে ৩ থেকে ৫ ফুট চওড়া করে।
রহমতখালী খালের পৌরসভার অংশে ঝুমুর, আধুনিক হাসপাতাল সংলগ্ন ডায়াবেটিস হাসপাতাল, পৌর শিশু পার্ক, শিল্প কলোনি, বাজার ব্রিজের পূর্ব ও উত্তর অংশে মোট ৬টি ব্রিজ হয়েছে। পৌরসভার নির্মাণাধীন এ ব্রিজগুলো পুরোপুরি অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। খালের স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়েও ব্রিজের উচ্চতা অনেকটা নিচে। রহমতখালী খালের পানি প্রবাহে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ খালগুলো।
এছাড়া ঝুমুরের পূর্ব অংশে থাকা এ খালের ওপর অবৈধ স্থাপনা, বাজার ব্রিজের পশ্চিম অংশ থেকে মুরগি বাজার পর্যন্ত খালের ওপর দোকান পাট, ভবন নির্মাণ এবং বাজারের ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে খাল অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
খালের কচুরিপানাও পানি প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলার পানি নামার প্রধান ওয়াপদা খাল, ডাকাতিয়ায় রয়েছে শতশত টন কচুরিপানা। এসব আগাছার কারণে পানি যেতে পারছে না। সদর উপজেলার হোড়াখালী খালের প্রায় এক কিলোমিটার যেতে পড়েছে অন্তত ২০টি মরা গাছ। পাড়ের এসব গাছ পানিতে পড়ে আছে দিনের পর দিন। এসব গাছে ময়লা আবর্জনা আটকে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে।
খাল দিয়ে পানি নামার জন্য তৈরি করা হয়েছে স্লুইস গেট। কিন্তু স্লইস গেটও দখল হয়ে আছে। নদীর জোয়ার ও সেচের পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের আমলে লক্ষ্মীপুরে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য রেগুলেটর এবং স্লুইস গেট।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরে বিভিন্ন খালে ৮টি রেগুলেটর এবং ২৩টি স্লুইস গেট রয়েছে। প্রায় সবগুলো স্লুইস গেট দখল হয়ে গেছে।
ভুলুয়া নদের শাখা রাতাচূড়া খালের স্লুইস গেটটি দখল করে স্থানীয়রা বাজার বসিয়েছে। এতে ৬টি গেটের মধ্যে ৪টি গেট বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে একই বেড়িবাঁধের মৌলভীরহাট বাজার স্লুইস গেট, চৌধুরী বাজার স্লুইস গেট এবং তোরাবগঞ্জ পূর্ব বাজারের স্লুইস গেটটি স্থানীয়রা দখল করে দোকান-পাট তৈরি করেছে। এ স্লুইস গেটগুলো দিয়ে ভুলুয়ার পানি বিভিন্ন খাল হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়তো।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, জেলার প্রায় ৮০ ভাগ স্লুইস গেট দখল করে স্থানীয়রা বাজার তৈরি করেছে। এতে ওই খালগুলো দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র আরও জানায়, লক্ষ্মীপুরে প্রধান তিনটি নদী ছাড়াও ৯৯টি ছোট বড় খাল এবং এদের শাখা খাল রয়েছে। যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৪৯৮ কিলোমিটার। অন্যদিকে ৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভুলুয়া, ২৩ কিলোমিটার ডাকাতিয়া এবং মেঘনা নদীর ৫০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে লক্ষ্মীপুরে। সবগুলো খালের পানি ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্বে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু খাল সংস্কার করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।
লক্ষ্মীপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইকরামুল হক জানান, লক্ষ্মীপুরের প্রায় সবগুলো খাল বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে। গত অর্থ বছরে লক্ষ্মীপুরে মাত্র ৩টি খালে প্রায় ৭ কিলোমিটার সংস্কারের আদেশ দেওয়া হয়। এই সামান্য খাল সংস্কার করতে গেলে বন বিভাগের গাছ, খালের সীমানা নির্ধারণ এবং প্রভাবশালীদের বাধায় খাল সংস্কারে বড় সমস্যা তৈরি হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) লক্ষ্মীপুর সেচ বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএডিসি লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন খালে ১৪০ কিলোমিটার সংস্কার করেছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান জানিয়েছেন, বর্তমানে লক্ষ্মীপুরে যে বন্যা হচ্ছে তার বেশিরভাগ অংশই জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কারণ লক্ষ্মীপুরের বিশাল জনগোষ্ঠী পানিবন্দি হলেও মেঘনা নদীতে পানি নেই। পূর্বাঞ্চল (ওপরের অংশ) থেকে পশ্চিম অংশ (ডাল) মেঘনায় পানি যেতে পথে পথে বাধা রয়েছে। জলাবদ্ধতার মূল কারণ দখলবাজি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন। এ কারণে বৃষ্টিপাতের পানি নদীতে নামতে পারেনি।
একই সঙ্গে ওই পানিতে যুক্ত হওয়া নোয়াখালী ও ফেনীর বন্যার পানি এসে পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। আমরা এখন এ অতিরিক্ত পানি নেমে যেতে আমাদের সব খালগুলো এবং স্লুইস গেটগুলো ২৪ ঘণ্টা তদারকি করছি। পাশাপাশি এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থানের ১৫০টি স্থানে অভিযান করেছি। আমাদের অফিসাররা বিরামহীন কাজ করছে। আমরা আগে পানি নামাতে চাই, পরে দীর্ঘ স্থায়ী সমাধানের পথে এগোবো।
এ কর্মকর্তা বলেন, খাল নদী দখলমুক্ত করতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি বিভাগ, বন বিভাগ, দুর্যোগ ও ত্রাণ বিভাগ, ভূমি প্রশাসন, পুলিশ ও সিভিল এবং স্থানীয় লোকজনকে যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে খাল নদী দখলমুক্ত করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হলে আগে খালের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। অনেকেই সংস্কারের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন পানির মধ্যে এমন শত শত খালে সংস্কার সম্ভব না। তবে এখন যা দরকার তা হলো, খালের বাঁধ কেটে দেওয়া, জাল উঠিয়ে দেওয়া, আবর্জনা পরিষ্কার করে দেওয়া। এটাই আপাতত জরুরি সমাধান। আমাদের লোকজন সেটাই করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২৪
আরএ