ঢাকা: ‘পাহাড় দখল’ চলছে অভিযোগ তুলে ‘দখলদাকারীদের’ তালিকা প্রকাশ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম এবং জনগণের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।
গোলটেবিল বৈঠকে আনু মুহাম্মদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমি বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধান করার ক্ষমতা আপনাদের কাছে নেই সেটা আমরা বুঝি৷ কিন্তু অনেক কিছুই আপনারা করতে পারেন৷ তার মধ্যে একটা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কাদের দখলে আছে সেগুলো প্রকাশ করেন৷ পাহাড়গুলো কাদের কাছে ইজারা দেওয়া? এ যে বিশাল বিশাল লুটেরা বিশাল বিশাল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, কিংবা সামরিক, বেসামরিক, অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ব্যক্তি, এমপি-মন্ত্রী, কাদের কাদের নামে পাহাড় আছে৷ পাহাড়গুলো কারা দখল করে আছে তাদের তালিকা প্রকাশ করেন৷
তিনি আরও বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাহাড় নষ্ট করে পাঁচ তারকা হোটেল বানানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে৷ ওখানে একটা পুঁজিবাদের রূপান্তর হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে বড় ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে সেনা শাসনের মাধ্যমে৷ কারণ সেনা শাসন থাকলে খবরা-খবর বাইরে যাচ্ছে না৷ কে কোনটা দখল করলো তার কোনো জবাবদিহিতা নেই, স্বচ্ছতা নেই৷
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বরাদ্দ, উন্নয়ন কর্মসূচি এটার সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ জবাবদিহি চাই৷ অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্নীতির তথ্যের জন্য সরকার একটা শ্বেতপত্র কমিটি করেছে৷ সেই শ্বেতপত্র কমিটির মতো পার্বত চট্টগ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কি কি বরাদ্দ গেল, কি কি কর্মসূচি গেল,সেগুলো কীভাবে আছে, কীভাবে ব্যয় হয়েছে সেটা জানার জন্য শ্বেতপত্র কমিটি চাই৷ এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷
তিনি আরও বলেন, গণহত্যার বিচার বিচার হয়নি, সেনা শাসন প্রত্যাহার করা, ভূমি সমস্যার সমাধান করা, সাংবিধানিক স্বীকৃতি হয়নি৷ স্যাটেলার শব্দ নিয়ে অনেকের মধ্যে মানসিক আপত্তি আছে৷ এটা ৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে স্যাটেলার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল৷ তার আগে যে বাঙালিরা সেখানে যায়নি তা না৷ আগে যেসব বাঙালি গেছে তাদের স্যাটেলার বলা হয় না৷ তাদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই৷ তারা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে৷ সমস্যাটা হলো যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল অন্য জাতিসত্তাকে সংখ্যালঘু করতে হবে এবং বাঙালিকে সংখ্যাগুরু করতে হবে৷
তিনি বলেন, দেশের ছিন্নমূল এবং গরিবদের যখন সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে বলা হলো, জমি দেওয়া হবে খাওয়া-দাওয়া হবে এবং সামরিক বাহিনীর প্রকল্পের অংশ হিসেবে তাদের সেখানে বসানো হলো৷ তখনই বাঙালি, পাহাড়ি, স্যাটেলার এ সমস্যাগুলো তৈরি হলো৷
গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয়তাবাদী মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফয়জুল হাকিম লালা বলেন, বাংলাদেশ যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র না হয়, গণতান্ত্রিক সংবিধান না হয়, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে সেটা আশা করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। শুধু এ অঞ্চলে নয়, পুরো উপমহাদেশের সমস্যা তৈরি করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। দুশমনকে তো চিহ্নিত করতে হবে। এ ভৌগলিক কাঠামো তৈরি করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। পুরো এ অঞ্চলে তারা সমস্যা তৈরি করে রেখেছে। জাতিগত দ্বন্দ্বসহ নানা রকম দ্বন্দ্ব তারা তৈরি করেছে। আজকে বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের যে মুক্তির সংগ্রাম সে সংগ্রামে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনতে হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার অপসারিত হয়েছে মাত্র। কিন্তু ফ্যাসিবাদী যে রাষ্ট্র, শাসক শ্রেণি, সমরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, লুণ্ঠনকারী ব্যবসায়ী শ্রেণি তারা তো ক্ষমতায় রয়েছে।
গত দুই মাসে পাহাড়ি ও বাঙালির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সম্প্রতি পাহাড়ে হওয়া সংঘর্ষের তদন্তে একটি গণতদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। কারণ, পাহাড়ে সংঘর্ষের পর তিনজন উপদেষ্ট সেখানে পরিদর্শনে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের যে সমস্যা, সেটি একটি রাজনৈতিক সংকট। পাহড়ের এ সংকট সামরিকীকরণ করে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং রাজনৈতিকভাবে সামগ্রিক এ সংকট সমাধান করতে হবে। কারণ পাহাড় নিরাপদ না হলে সমতল নিরাপদ হবে না। পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে, সমতলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
গণঅভ্যুত্থানের দুই মাস না পেরুতেই কেন পাহাড়ে রক্ত ঝরবে প্রশ্ন রেখে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু বলেন, পাহাড়ে দুই দিনে চারজন খুন হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো স্টেটমেন্ট পেলাম না। এর প্রতিবাদ জানাই৷ সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে হবে। পাশাপাশি এসব হত্যার জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, পাহাড়কে আমরা যেনো শুধু পর্যটন স্থান হিসেবে না দেখি। এটি পাহাড়িদের জীবন-যাপনের অংশ। আমরা হোটেল রিসোর্ট বানানোর জন্য যেনো তাদের জায়গা কেড়ে না নেই। এই বিষয়ে আমাদের জোর দিতে হবে।
চিকিৎসক হারুনুর রশিদ বলেন, পাহাড়ের মানুষ আসলেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আমরা যদি সত্যিই পাহাড়িদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। পাহাড়ের মানুষের ওপর আস্থা রেখে তাদের সঙ্গে সংকট সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, পাহাড়ে বেসামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা ছাড়া সেখানে শান্তি ফিরবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ সংকট সমাধান করতে হবে।
লিখিত বক্তব্য ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন, হাসিনার দুঃশাসন ও জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাহাড়ি জনগণ ইউপিডিএফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের বুক থেকে এখনো ফ্যাসিস্ট শাসনের জগদ্দল পাথর সরে যায়নি। পাহাড়ের মানুষ এখনো বুক ভরে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, কারণ সেখানে এখনো আগের মতো সেনাশাসন বলবৎ রয়েছে। গত ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়।
এ অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম ও জনগণের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৭ দফা প্রস্তাবনা দেয় ইউপিডিএফ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২৪
এসসি/জেএইচ