ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রবারণায় ফানুসে বর্ণিল আকাশ

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০২৪
প্রবারণায় ফানুসে বর্ণিল আকাশ

কক্সবাজার: একের পর এক আকাশে ওড়ানো হচ্ছে রঙবেরঙের ফানুস। ফানুসকে বৌদ্ধরা আকাশ প্রদীপও বলেন।

উড়তে উড়তে ফানুসগুলো মিশে যাচ্ছে দূর নীলিমায়। প্রবারণা পূর্ণিমার দিনে সন্ধ্যাকাশের এমন মুগ্ধতা প্রাণ ছুঁয়েছে শত শত নারী পুরুষের। এমন সময়ে মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশ পানে চেয়ে এক দর্শনার্থীর মন্তব্য- ‘কোনটি তারা কোনটি ফানুস তাও যেন এক কঠিন ধাঁধাঁ। ’

বুধবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দেখা মিলল কক্সবাজারের রামুতে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে শ্রীকুল গ্রামে মৈত্রী বিহার সংলগ্ন মাঠ ও মেরংলোয়ায় রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার মাঠে পৃথক ফানুস উৎসবের আয়োজন করা হয়।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতে, আকাশে ফানুস ওড়ানো কেবল বৌদ্ধদের উৎসব নয়, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। তাই ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সূত্র পাঠের মাধ্যমে ওড়ানো হয় ফানুস।

সীমা বিহারের ফানুসে বুদ্ধের নয় গুণ

রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার মাঠে এবারের ফানুস উৎসবের আয়োজনেও ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। এখান থেকে উত্তোলন করা হয়েছে  নয়টি ফানুস। তবে ব্যতিক্রম হল, প্রতিটি ফানুসে ছিল মহামতি গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধানুস্মৃতি। মূলত গৌতম বুদ্ধের নয় গুণকে স্মরণ করে ধ্যান করাই হল বুদ্ধানুস্মৃতি।

বুদ্ধের নয় গুণ ছাড়াও এবারও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবারও রংতুলির আঁচড়ে এ ধর্মীয় গুরুর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য বিপুল বড়ুয়া আব্বু।

বাংলাদেশি বৌদ্ধদের উপসংঘরাজ এই অঞ্চলের বৌদ্ধদের প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ও রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। ২০১৫ সালে সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর তার প্রয়াণ ঘটে। সীমা বিহারের উৎসবের একটি ফানুসে এই বৌদ্ধ ধর্মীয়গুরুর ছবি রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক সংগীত বড়ুয়া।

সংগীত বড়ুয়া বলেন, প্রায় পাঁচ বছর আগে সত্যপ্রিয় ভান্তে প্রয়াত হলেও পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের কাছে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। তার নাম আসলেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মাথা নত হয়ে আসে। তাই ফানুসে রং তুলি দিয়ে তার ছবিটি ধারণ করেছি।

এছাড়াও গৌতম বুদ্ধের প্রতিবিম্ব, বুদ্ধ জাদিসহ নানা ঐতিহ্য আঁকা হয়েছে। যে কারণে এবারের ফানুসগুলো বৌদ্ধ দর্শনার্থীদের মনে মুগ্ধতার পাশাপাশি শ্রদ্ধাবোধও বাড়িয়েছে বলে জানান এই শিল্পী।

অন্যদিকে শ্রীকুল মৈত্রী বিহারের মাঠে আয়োজিত উৎসবের প্রতিটি ফানুসে ছিল শিল্পের ছোঁয়া। শিল্পীর রং তুলির আঁচড়ে ফানুসগুলো হয়ে ওঠে একেকটি শিল্প কর্ম, যা উৎসবে বৈচিত্র্য এনেছে। বাড়িয়েছে ভাবগাম্ভীর্য বিশেষত্ব, পেয়েছে শিল্পরূপ।

কলেজছাত্রী প্রেরণা বড়ুয়া স্বস্থি বলেন, এখানকার সবকটি ফানুসই অসাধারণ শিল্পকর্ম। আর এতটা আনন্দমুখর পরিবেশে ফানুস ওড়ানো হয়, দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

ফানুস কেন ওড়ানো হয়

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বাংলানিউজকে জানান, ‘শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে রাজকুমার সিদ্ধার্থ (গৌতম বুদ্ধ) দুঃখমুক্তি লাভের আশায় রাজ্য, রাজত্ব, ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ, সংসার সবকিছু ত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে রাজ আবরণ সারথি ছন্দককে বুঝিয়ে দিয়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন।

এ সময় ভাবলেন, ‘আমি এখন সন্ন্যাসী, রাজকীয় এ বাহারি চুল আমার কিবা প্রয়োজন। তাই তরবারি দিয়ে নিজের চুলের গোছা নিজেই কেটে নিলেন এবং মনে মনে ভাবলেন, ‘যদি আমার মধ্যে বুদ্ধ হওয়ার মতো পারমী থাকে তাহলে এই চুলের গুচ্ছ মাটিতে পড়বে না, আকাশেই স্থিত থাকবে। এই সংকল্প করে চুলের গোছা ওপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন রাজকুমার। আশ্চর্যের বিষয় একটি চুলও মাটিতে পড়ল না।

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু আরও বলেন, ‘বৌদ্ধ ধর্ম মতে, স্বর্গের ইন্দ্ররাজা এই চুলগুলো হীরা, মণিমাণিক্য খচিত স্বর্ণপাত্রে ধারণ করে, এ চুলকে কেশ ধাতু হিসেবে স্থাপন করে তাবতিংস স্বর্গে একটি চৈত্য নির্মাণ করেন এবং এই চৈত্যের নাম রাখা হয় চুলামনি চৈত্য। সেই বিশ্বাস থেকে বৌদ্ধরা স্বর্গের সেই চুলামনি চৈত্যকে পূজা করার উদ্দেশে আকাশে ফানুস বা আকাশ প্রদীপ উত্তোলন করেন।

মূলত আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে ফানুস উত্তোলনের যথার্থতা বেশি। তবে সেই সময় বৃষ্টি এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমার দিনে ফানুস ওড়ানো হয় বলে জানান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০২৪
এসবি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।