পাথরঘাটা (বরগুনা): কয়েকদিন ধরেই ছিল আকাশে কালো মেঘ, গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, দকমা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল সেদিন। কিছুক্ষণ পরপর রেডিওতে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের খবর প্রচার করা হয়েছিল।
উপকূলে পর্যাপ্ত রেডিও না থাকায় অধিকাংশ মানুষই সেদিন মহাবিপদ সংকেতের খবরটি জানতে পারেনি। তখনও উপকূলবাসী বুঝতে পারেনি কি হতে যাচ্ছে। গভীর রাতে প্রায় ২২২ কিলোমিটার গতিবেগে মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল থাবা পাথরঘাটাসহ উপকূলীয় জেলাগুলো সব উলট-পালট করে দেয়। এতে উপকূলের ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ বিসর্জন দেয়। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি ও স্বজনহারা উপকূলবাসীকে এখনও কাঁদায়।
১২ নভেম্বর দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে বরগুনা জেলার উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
কথা হয় ১১০ বছর বয়সি আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওই বন্যায় মোর পরিবারের পাঁচজন লোক মারা যায়। ’ সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে আবুল হোসেন বলেন, সকাল হওয়ার পর দেখি লাশ আর লাশ। আজও চোখের সামনে ভাসে গাছে গাছে সারিবদ্ধ লাশ।
আবুল আরও বলেন, ঝড়ের সময় বন্যায় তাদের ঘর ভেঙে এবং তলিয়ে যাওয়ায় তারা কাঁঠাল গাছের মাথায় উঠেছিলেন। ভাগ্যক্রমে তারা কয়েকজন বেঁচে গেলেও ছোট ভাই আদম আলী, তার স্ত্রী ও ছেলেসহ পাঁচজন সদস্য পানিতে ভেসে মারা যায়।
আব্দুর রব, বয়স ৭৬ বছর। এই বয়সে দেখেছেন বন্যাসহ অনেক রকম দুর্যোগ। কিন্তু তার কথায়, ৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসের মতো কোনো দুর্যোগ বা লাশের সারি দেখেননি তিনি। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ংকর স্মৃতিচারণ করলেন আব্দুর রব। ওই দুর্যোগে প্রাণহানি হয় ৭ লাখের বেশি মানুষের। দীর্ঘ বছরেও সেই ভয়াল দিনের কথা ভোলেনি উপকূলবাসী।
তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ির কাছে একটি খাস পুকুরে ২৫ থেকে ৩০টি লাশ পেয়েছি। ওই লাশ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দাফন দিয়েছি। অনেক লাশের জানাজাও দেওয়ার সুযোগ হয়নি। আজও সেই কথা মনে পড়লে গাঁ শিউরে ওঠে। ’
সিরাজুল হক মোল্লা বয়স ৮০ বছর। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পরেই হঠাৎ ঝড়ো বাতাস শুরু। মুহূর্তের মধ্যে পানিতে তলিয়ে যায় সব এলাকা। ঘরবাড়ি, গাছপালা ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। সকালে উঠেই দেখা যায় খাল, বিল, ধানে ক্ষেতে এবং গাছের মাথায় লাশ আর লাশ। তিনি আরও বলেন, এরকম ভয়াবহ অবস্থা এবং লাশের সংখ্যা আমার বয়সে আর দেখিনি।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের দিনটি ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে আজ। যেসব কর্মসূচি রয়েছে আজ - শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, ঘূর্ণিঝড়ে প্রয়াতদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জলন এবং স্মারকলিপি পেশ।
এ দিবস উপলক্ষে বরগুনার পাথরঘাটায় পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের আয়োজনে সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ চত্বরের মুক্তমঞ্চে ‘উপকূল দিবস’র দোয়া করা হয় এবং সিডরে নিহত ও ১৯৯৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাগরে নিখোঁজ জেলের স্বজনদের মাঝে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২৪
আরএ