লক্ষ্মীপুর: আজ ৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর।
লক্ষ্মীপুরে হানাদারবিরোধী মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ প্রতিরোধ ছিল এটি। ৯ মাসে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্নস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ৩৭টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয় রনাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধে শহীদ হন ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো সময় জুড়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় রাজাকার বাহিনী হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনার মতো বর্বরতা চালায়।
অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য গেরিলা যুদ্ধ তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের বাগবাড়ির মিলেশিয়া ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দিঘীর পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাইস্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে জমিদার হাট সংলগ্ন উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও এল এল হাইস্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ সময় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শীহদ হন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর হাতে শত শত হানাদার ও রাজাকার নিহত হয়। জেলায় মোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১৪।
লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রীজ, বাগবাড়ি গণকবর, দালাল বাজার গালর্স হাইস্কুল, মডেল হাইস্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদরাসা, এল এম হাইস্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদরাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমলনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো ছিল হানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প এবং গণহত্যার স্থান।
সূত্র জানায়, নভেম্বরের শেষের দিকে রায়পুর আলীয়া মাদরাসায় হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বাসু শহীদ হন।
লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর মিলেশিয়াদের বাগবাড়ী ক্যাম্প অনেক দূর থেকে ঘেরাও শুরু করে। প্রবল গুলিবর্ষণ করতে করতে ওই ঘাঁটির রাজাকার ও হানাদারদের অবরুদ্ধ রেখে ৩ ডিসেম্বর ঘাঁটির খুব কাছাকাছি গিয়ে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাড়াঁশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যায় হানাদাররা। ৪ ডিসেম্বর ভোরে হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে লক্ষ্মীপুর ছেড়ে চলে যায়।
বিভিন্ন ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্য মতে, যুদ্ধের ৯ মাস লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ বিশাল সারের গুদামটি ছিল মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি ও টর্চার সেল। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী স্থানীয় বাঙালিদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। পরে এদের ধরে রহমতখালী খালের ওপর মাদাম ব্রিজের ওপর থেকে গুলি করে হত্যা করে মরদেহ খালে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। পরে মুক্তিসেনারা ওই ব্রিজটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। ভগ্নদশা নিয়ে পরিত্যক্ত মাদাম ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন ও স্মৃতি নিয়ে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি।
এদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিপুল সংখ্যা মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে বাগবাড়ি টর্চার সেল সংলগ্ন একটি স্থানে পুঁতে রাখে। বর্তমানে সে স্থানটিকে গণকবর হিসেবে সংরক্ষিত করা হয়েছে।
শহীদ ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্লাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো. মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এসএম কামাল, মিরাজ উল্ল্যা, মো. আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেনু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল রশিদ।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নিয়ে লক্ষ্মীপুরের মোট ১১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২৪
আরএ