ঢাকা: দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংস অবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা, করোনাকালীন দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবে শিশুদের মধ্যে দারুণ প্রভাব ফেলছে।
শিশু মনে এসব ঘটনাবলীর প্রভাবে ভীতি বা আতঙ্কগ্রস্ত ৫৫ দশমিক দুই শতাংশ শিশু, লেখাপড়ায় অমনোযোগী ৩৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ শিশু, স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা ৩৬ দশমিক নয় শতাংশ শিশু, শিশুদের মানসিক ক্ষতি সাধন ২৮ দশমিক ছয় শতাংশ এবং শিশুদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার হার সাত দশমিক নয় শতাংশ।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় উত্থাপিত গবেষণাপত্রে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের যৌথ আয়োজনে এ জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপের তথ্য উপস্থাপন করেন টিচার ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হক ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের কার্যক্রম ব্যবস্থাপক আব্দুর রউফ।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। সভা প্রধান হিসেবে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমেদ মোশতাক রাজা। সম্মানিত অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অ্যাডভাইজর ড. মুহাম্মদ মুসা। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ।
দেশের আটটি বিভাগের মোট ২০৩টি সংগঠনের সহায়তায় গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ৩৬০ জনের উপস্থিতিতে ১২টি ফোকাস গ্রুপের আলোচনা, ৩০ জন তথ্যাভিজ্ঞ ব্যক্তির মতামত, দুটি বিভাগীয় এবং দুটি জাতীয় পর্যায়ের সভার মাধ্যমে গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় ৬০০ উপস্থিতির মাধ্যমে।
শিশুদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন নিয়ে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মানসিক অস্থিরতা বা ট্রমায় ৪৫ দশমিক আট শতাংশ, শিক্ষায় অমনোযোগ ১৯ দশমিক দুই শতাংশ, উচ্ছৃঙ্খলতা ১৫ দশমিক তিন শতাংশ, শিক্ষাক্রমের বিরূপ প্রভাব চার দশমিক চার শতাংশ, ডিভাইসে আসক্তি ১৩ দশমিক আট শতাংশ, ভীত সন্ত্রস্ত থাকা শিশু ছয় দশমিক নয় শতাংশ, আতঙ্কিত থাকা ২৩ দশমিক দুই শতাংশ, নিরাপত্তাহীনতা ১৯ দশমিক সাত শতাংশ।
আর জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতামত অনুযায়ী পাওয়া শিশুদের মধ্যে দৃশ্যমান মানসিক পরিবর্তনের তথ্যও তুলে ধরা হয়। এতে ভীতি বা আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া ৫৫ দশমিক দুই শতাংশ, পড়ালেখায় অমনোযোগী ৩৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ, স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা ৩৬ দশমিক নয় শতাংশ, শিশুদের মানসিক ক্ষতি সাধন ২৮ দশমিক ছয় শতাংশ এবং শিশুদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া সাত দশমিক নয় শতাংশ।
শিশুদের মনে প্রভাব ফেলেছে এমন কিছু ঘটনা:
শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে; মিছিল, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি দেখেছে; রাজপথে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়া দেখেছে বা শুনেছে যা তাদের মনে আতঙ্কের জন্ম দেয়।
এছাড়াও, স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কারফিউ ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঘরে থাকতে হয়েছে; দেওয়াল লিখন ও আঁকা ছবিতে সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে প্রভাবিত হয়েছে; পরিবারে বা আশেপাশে শিক্ষার্থীদের গুরুতর আহত হওয়া বা মৃত্যু দেখেছে; বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও শিক্ষা উপকরণ ভেসে গেছে; শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে কোনো বিষয় নিয়ে আন্দোলন করার প্রবণতা বেড়ে গেছে।
সুপারিশ:
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অভিভাবকদের জন্য সুপারিশ, বিদ্যালয়ের জন্য সুপারিশ, এনজিও বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুপারিশ এবং সরকারের কাছে নানা সুপারিশ করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতে সরকারের করণীয় তুলে ধরা হয়।
শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ও সরঞ্জাম চেয়েছেন ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ; বিনোদন কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা বলেছেন ২২ দশমিক দুই শতাংশ; শিশু সুরক্ষা আইন-২০১৩ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন সাত দশমিক নয় শতাংশ; চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা ১৬ দশমিক তিন শতাংশ; টিভিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানের নিয়মিত আয়োজন চেয়েছেন ১১ দশমিক আট শতাংশ; শিশুদের দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার মত দিয়েছেন ১০ দশমিক তিন শতাংশ; বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ব্যবস্থা করা ১৬ দশমিক তিন শতাংশ; শিশুদের নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন ৫৫ দশমিক দুই শতাংশ এবং শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশী কার্যক্রম হাতে নিতে বলেছেন সাত দশমিক নয় শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদনে সরকারে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শিশু সুরক্ষা আইন-২০১৩ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা, শিক্ষক-প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ট্রমা কাউন্সেলিং কর্মসূচি আয়োজন করা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা নিরূপণের জন্য শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের খোলার মাঠ ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় পর্যাপ্ত সম্পদ ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪
এমআইএইচ/আরআইএস