ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ: বোমার খোলসে যুদ্ধের স্মৃতি

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ: বোমার খোলসে যুদ্ধের স্মৃতি

পাবনা (ঈশ্বরদী): ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে ভারতীয় মিত্রবাহিনী তখন দ্রুত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বেতারে এবং আন্তর্জাতিক চ্যানেলে আহ্বান করছিল।

চারদিক থেকে হানাদারমুক্ত হওয়ার খবর আসছিল। তখনও পাবনার ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছিল।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে হানাদার বাহিনী সেদিন (১৪ ডিসেম্বর) ঈশ্বরদীতে আসছিল। সেদিন সকাল ১১টার দিকে ঈশ্বরদীর বিস্তীর্ণ পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের আকাশে বেশ কয়েকটি ভারতীয় বোমারু বিমান উড়তে দেখা যায়। হঠাৎ করে বিকট একটি শব্দ। উত্তর-দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতেই ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর পরপর কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে। এতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের পশ্চিম দিকের মাথা ভেঙে পদ্মার পানিতে পড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যান।  

যখন ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে বোমা নিক্ষেপ করেছিল, ঠিক তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি ও একটি ট্যাংক ব্রিজের ওপর দিয়ে পার হচ্ছিল।  

১২ নম্বর স্প্যানটি ভেঙে পড়ার পর ওই ট্যাংকটি ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। কয়েকজন হানাদার সেনার লাশও ব্রিজের স্প্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত ছিল। আর একটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ব্রিজের পূর্ব দিকে পড়ে ছিল। স্বাধীনতার পর ভারতীয় মিত্র বাহিনী শেলটি ফাটিয়ে দেয়।  

শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) সকালে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম) চত্বরে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বোমার খোলসটি রাখা রয়েছে। লোহার খোলসটির ওজন প্রায় ৮০ কেজির বেশি। যা লাল-সাদা রং দিয়ে সিমেন্টের বেদীর ওপর সযত্নে গাঁথা রয়েছে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৩ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে বোমার ওই খোলসটি দেখতে প্রতিদিনই দেশের দূর-দূরান্তর থেকে ছুটে আসেন সব বয়সের মানুষ ও দর্শনার্থীরা।  

দেশ স্বাধীনের পর দেশে রেল যোগাযোগ রক্ষার স্বার্থে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৎকালীন ভারত সরকার ব্রিটিশ আমলের নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মতই ব্রিটিশ আমলের প্রকৌশলীদের আদলেই অন্য সব গার্ডারের মতো মিল রেখেই ১২ নম্বর স্প্যান প্রতিস্থাপন করার পর ওই বছর থেকে হার্ডিঞ্জ রেল সেতুর ওপর দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের তৎকালীন ছাত্রলীগ স্কুল শাখার কর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা (বীর মুক্তিযোদ্ধা) পাকশীর দিয়াড় বাঘইল-সাহাপুরের মাঝামাঝি অবস্থান করছিলাম। ওরা (পাকিস্তানি সেনারা) বেশ ক্ষুধার্ত ছিল। ঈশ্বরদী-খুলনা রেললাইনের পাকশী নর্থবেঙ্গল পেপার মিলের টানেলের রেললাইনের কিনারে বসে পাকিস্তানি সেনারা কাঁচা বেগুন খাচ্ছিল। আমরা (বীর মুক্তিযোদ্ধারা) আত্মসমর্পণের কথা বলতেই হানাদার সেনারা বলে ওঠে, -এ্যাহ শ্যালে বাঙালি হ্যায়' ( এ তো বাঙালি) বলেই বৃষ্টির মতন গুলি ছুড়তে থাকে। আমরাও তখন পাল্টা গুলি চালাই। সেসময় আমরা এক হয়ে অনেক পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলি।  

হাবিবুল ইসলাম হাবিবুল আরও বলেন, এ খবর পেয়েই, পাকিস্তানি সেনারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) ইপিআরের মাধ্যমে দমদম এয়ারপোর্টে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সাহায্য চাই। দুপুরের দিকে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে পাঁচটি যুদ্ধ বিমান থেকে কয়েকটা বোমা নিক্ষেপ করে। একটি বোমার আঘাতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের একটি স্প্যান ভেঙ্গে পদ্মা নদীতে পড়ে যায়। আরেকটি বোমা পাকশী স্টেশনের কাছে পড়ে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। আরেকটি বোমা বালুচরের মধ্যে পড়েছিল।

পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাইফুজ জামান পিন্টু বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রিয় পাকশী ইউনিয়নে আজও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছেন বোমার খোলসটি। আজকের তরুণ প্রজন্মদের কাছে এখনও ইতিহাস। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, বোমার খোলসটিকে দেখে কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভব করে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র পেতে পাকশীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।  

পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের প্রকৌশলী-২ বীরবল মন্ডল বাংলানিউজকে জানান, দেশ স্বাধীনের শেষ সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ ব্যাহত করতে মিত্রবাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত বোমার খোলসটি পাকশী বিভাগীয় অফিসে সংরক্ষণ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেশ ও জাতি তথা নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।  

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ বাংলানিউজকে জানান, মহান স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও বোমার খোলসটি মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি হয়ে আছে  নতুন প্রজন্মদের কাছে।  

৭১ এর বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়েছিল। একটি বোমার খোলস এখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। বোমার খোলসটি দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন।  

ডিআরএম শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ আরও জানান, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের প্রকৌশলী বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পাকশী ডিআরএম চত্বরের সামনে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বোমার খোলসটি রাখা রয়েছে। জাতীয় দিবসে বোমার খোলসটি পরিষ্কার, সংরক্ষণ ও রং করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।