ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

পর্যটন নগরে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪
পর্যটন নগরে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। ফাইল ছবি

সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকারে ডুবে যায় পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার শহর। এর সঙ্গে হারিয়ে যায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য।

আর একটু রাত হলে তো পুরো শহরই যেন মৃতপ্রায়। সড়কে পর্যাপ্ত বাতি না থাকায় শুধু সৌন্দর্য নয়, নিভে যেতে থাকে কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তাও।

পর্যটকরা এই দৃশ্য দেখে তুলনা হিসেবে টেনে আনেন পদ্মাপারের শহর রাজশাহীর কথা। রাতের বেলায় নান্দনিক সড়কবাতির আলোয় মুগ্ধতা ছড়ায় যে শহর। সুশৃঙ্খল আলোকসজ্জা শহরের সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা বাড়িয়েছে বহুগুণ। কক্সবাজারেও এমন আলোকসজ্জার দাবি তাঁদের।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে এসে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা। সন্ধ্যার পর থেকে সৈকতের ঝাউবীথির আড়ালে থাকে ছিনতাইকারীদের আনাগোনা। আবার ভোরে সৈকত ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকরাও শিকার হন ছিনতাইকারীদের। প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

বিশেষ করে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর ছিনতাইকারীদের উৎপাত বেড়ে গেছে উদ্বেগজনকভাবে।

জানতে চাইলে কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজল বলেন, পর্যটকদের সুরক্ষা দিতে পারলে পর্যটন খাত বিকশিত হবে। শহরের বাতিগুলো বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি মেরিন ড্রাইভেও সড়কবাতির ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে যারা শাহপরীর দ্বীপসহ অন্যান্য এলাকায় ঘুরতে যায়, তাদের সন্ধ্যা নামার আগেই শহরে ফিরতে হয়।

৫ আগস্টের পর পর্যটন খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে কেউ নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে কি না তা খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

সরেজমিন কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ৬.৮৫ বর্গকিলোমিটারের কক্সবাজার শহরে রয়েছে পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক ভবন। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে থেকে ডলফিন মোড় দিয়ে প্রবেশ করলেই কক্সবাজার শহরের শুরু। এর মধ্যে নতুন বিচ রোড, কলাতলী বিচ, সুগন্ধা বিচ, লাবনী বিচসংলগ্ন এলাকাজুড়ে পর্যটকদের যাতায়াত বেশি। কিন্তু শহরের মূল সড়কগুলোর কোথাও সড়কবাতি নেই।

এমনকি বড়বাজার, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, সদর থানা, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়ের সামনেও অন্ধকার। বিভিন্ন হোটেল-মোটল ও স্ট্রিট ফুডের দোকানের আলোই পর্যটকদের ভরসা। সড়কবাতি না থাকায় কক্সবাজার শহরে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এখানে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২২টি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। কলাতলী বিচ এলাকার ছিনতাইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাসেল, মেহেদী, আফসারসহ ১০ থেকে ১২ জনের গ্রুপ। এদিকে সুগন্ধা বিচ এলাকায় ছিনতাইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে মোশারফ, আরিফ, বাবুলসহ আরো ১০ থেকে ১৫ জনের গ্রুপ।

সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, শৈবাল পয়েন্ট, লাবনী পয়েন্টের উত্তর পাশের ঝাউবীথি ও সিগাল পয়েন্টের ঝাউবীথি এলাকা ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। ঝাউবীথিতে সন্ধ্যার পর ওৎ পেতে থাকে কিশোর ছিনতাইকারীর দল। সেখানে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে ছিনতাইকারীর দল সুযোগ বুঝে বালুচরে বসা বা ভ্রমণরত পর্যটকদের ধরে ঝাউবীথির আড়ালে ঢুকিয়ে টাকা পয়সা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের ঘোনারপাড়া, বৈদ্যেরঘোনা, পাহাড়তলী, বাহারছড়া ও মোহাজের পাড়া এলাকার কিশোরের দলের সঙ্গে অনেক রোহিঙ্গাও রয়েছে ছিনতাই অপকর্মে। তবে বড় মাপের তিনজন ছিনতাইকারী এখন সৈকত ভ্রমণকারীসহ এলাকার পর্যটন ব্যবসায়ীদের তটস্থ করে রেখেছে। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট তাদের বিচরণ ক্ষেত্র। রাসেল, মেহেদী ও নুরু নামের দুর্ধর্ষ এই তিন ছিনতাইকারীর সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। এসব ছিনতাইকারী পর্যটকদের টার্গেট করে রাখে। এরপর সুযোগ বুঝে ছিনতাই করে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে রাতভর ছিনতাইকারীরা সৈকতে তৎপর থাকে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো মাহফুজুল ইসলাম গত সোমবার বলেন, কক্সবাজারের তিনটি পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। এসবের মধ্যে কক্সবাজার শহরের সাড়ে তিন কিলোমিটার সৈকত ছাড়াও ইনানী এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশের চলমান কার্যক্রম। ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তা রক্ষায় দিনরাত পুলিশ কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

নিরাপত্তা জোরদারের দাবি পর্যটকদের
কক্সবাজার ঘুরতে এসে পিক পকেটিংয়ের শিকার হয়েছেন হেলথকেয়ার ফার্মার কর্মকর্তা লিটন কুমার বালার স্ত্রী শ্যামলী কর্মকার। লিটন কুমার বালা বলেন, ‘১১ ডিসেম্বর কম্পানির বার্ষিক অনুষ্ঠানে সপরিবারে হাজির হই। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলাতলী বিচে কেউ একজন আমার স্ত্রীর মোবাইলটি চুরি করে নিয়ে যায়। পরে আমরা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অফিসে অভিযোগ দিই। পাশাপাশি নিজ জেলায় মোবাইল হারানোর জিডি করি। সড়কবাতি না থাকায় এমনটি হয়েছে বলে আমার ধারণা। আলোর স্বল্পতার কারণে কিছু ব্যক্তি একত্র হয়ে এমনটি করেছে। ’

একই রকমের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা আব্দুর রউফ মোল্লার সঙ্গে। ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় তাঁর মোবাইল ফোন চুরি যায়। রাস্তা পার হওয়ার সময় কেউ তাঁর পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। পাশাপাশি সড়কেও বাতি নেই। মোবাইল হারানোর পরই অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোবাইল ফিরে পাইনি। ’

কলাতলী বিচে কথা হয় নাটোর থেকে ঘুরতে আসা হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লোকমান হোসেনের সঙ্গে।  
তিনি বলেন, পর্যটন নগরীতে এত অব্যবস্থাপনা থাকলে কি মেনে নেওয়া যায়। সড়কের বাতিগুলো জ্বলে না। বিচেও পর্যাপ্ত আলো নেই।

চাঁদপুর থেকে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী হানিফ বলেন, রাতের কক্সবাজারে যে উজ্জ্বলতা থাকার কথা তা দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ পর্যটনকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে উচ্চমাত্রার আলোকসজ্জা করা হয়। কিন্তু কক্সবাজারে ভিন্নরূপ। ১৬ ডিসেম্বর গেল, সামনে বর্ষ সমাপনী দিন। কিন্তু হোটেল-মোটলে তেমন সাজসজ্জা দেখা যাচ্ছে না। সড়কবাতিও জ্বলছে না, যা সাধারণের মনে ভীতির সঞ্চার করে।

কলাতলী বিচ থেকে গাজীপুরের কাপাসিয়ার বাসিন্দা বাবুলের মোবাইলও ছিনতাই হয়। তাঁর মেয়ে খাদিজা আফরোজ বলেন, ‘আমরা হোটেল থেকে বিচের দিকে যাচ্ছিলাম। সড়কের পাশ দিয়ে দড়ি ছাড়া দুটি গরুও যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এর মধ্যেই বাবার মোবাইলটি কে বা কারা নিয়ে যায়, আমরা বুঝতে পারিনি। ’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘বিচ ও বিচের আশপাশের এলাকায় চুরি-ছিনতাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই পর্যটকরা এ সংক্রান্ত অভিযোগ আমাদের দেন। আমরা সদর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দিই। কেউ যায়, কেউ যায় না। ’

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।