ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বিবিসি বাংলার চোখে চব্বিশের বাংলাদেশ

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪
বিবিসি বাংলার চোখে চব্বিশের বাংলাদেশ কোলাজ ছবি

ঢাকা: নানা ঘটনার সাক্ষী ২০২৪। বছরজুড়ে নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আন্দোলন-বিক্ষোভ, সরকার পতন, নতুন সরকার গঠনের মতো একের পর এক চড়াই উৎরাইয়ের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ।

মুখোমুখি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সমীকরণের।

আরেক বিতর্কিত ভোট

২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে। সেই টানাপোড়েনের মধ্যেই ০৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতি এবং ভোটার উপস্থিতির হারের কারণে বিতর্কিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিতর্কিত এই নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

ভারত বিরোধী প্রচারণা ও রাজনীতি

নির্বাচনের পরপর নতুন রূপে ভারত বিরোধী রাজনীতি দানা বাঁধতে থাকে বাংলাদেশে। গতি পায় ভারতীয় পণ্য বয়কট, বয়কট ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন। বিতর্কিত নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার জন্য দায়ী করা হয় ভারতের সমর্থনকে।

দুর্নীতি, ছাগল কাণ্ড এবং অন্যান্য

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ বাংলাদেশ বরাবরই নিচের দিকে অবস্থান করে। ২০২৪ সালের শুরুতে সংস্থাটি জানায়, আগের বছরে জরিপ অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশটির অবস্থান দশম।

চব্বিশে সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতি সংক্রান্ত খবর ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। আরও কয়েকটি দুর্নীতির খবরও আলোড়ন তোলে জনপরিসরে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার ‘অঢেল সম্পদ’ নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম।

ঈদ উল আযহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদের আগে একটি অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে কোরবানি উপলক্ষে ‘১৫ লাখ টাকার’ একটি ছাগল কিনতে গিয়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দেন মতিউর রহমান নামে এক রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলে।

এই খবরের সূত্র ধরে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল

ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। এর ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়।

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কথা বলেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দাবির সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায়ের পর শিক্ষার্থীরা পথে নেমে আসেন রাজপথে।

ঘটনাবহুল জুলাই: আন্দোলনের মাস

কোটা সংস্কার আন্দোলনের একই সময়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা থেকে নিজেদের নাম কাটাতে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পৃথক আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত এবং একইসঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রমের দিক থেকে স্থবির হয়ে পড়ে।

টানা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এর মধ্যে ১০ তারিখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দেন আপিল বিভাগ। তবে পরবর্তী শুনানির সময় ধার্য করা হয় চার সপ্তাহ পর।

‍ওইদিন দিবাগত রাতে চীন সফর থেকে ফেরেন শেখ হাসিনা। ১৪ জুলাই চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসলে সরকারের কিছু করার নেই। ’

তিনি সেখানে প্রশ্ন করেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’

তার এই বক্তব্যের জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় স্লোগান দিতে দেখা যায় – ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। ’ বিক্ষোভ মোকাবিলায় বলপ্রয়োগের পথে হাঁটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

সহিংসতায় রক্তাক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর জানা যায়। দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘাতে আহত হন অনেকে। ১৬ জুলাই প্রথম প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় সারা দেশে ছয় জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো ও নিহত হওয়ার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

দেশজুড়েই বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে ওঠেন রংপুরের এই শিক্ষার্থী। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। যা ক্ষমতাসীন দলের কোনো সংগঠনের জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

১৭ জুলাইও সংঘাত সহিংসতা অব্যাহত থাকে। দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

কমপ্লিট শাটডাউন

হত্যা ও হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিন রাজধানীর শনির আখড়ায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক।

বাড্ডা, উত্তরা, যাত্রাবাড়ি ও মিরপুর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘাত-সহিংসতার খবর আসতে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম - বাংলাদেশ টেলিভিশনের বা বিটিভি ভবনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা।

এদিন ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় বিপুল সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সমবেত হন। তাদের সঙ্গে কোথাও কোথাও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হতে পেরেছিল বিবিসি বাংলা। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হবে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ইন্টারনেটের সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ইন্টারনেট। রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ হয়ে যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

১৯ জুলাই শুক্রবারও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলতে থাকে। জনপদগুলোতে থমথমে হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ঢাকায় মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিতভাবে জানা যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার সংখ্যাও তার বেশ কয়েক গুণ বেশি ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রাত ১২টা থেকে জারি করা হয় কারফিউ।

জুলাইয়ের শেষ ১০ দিন

কারফিউর মধ্যেও ২০ জুলাই শনিবার ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নিহত হন অন্তত ২৬ জন।

২২ জুলাই আপিল বিভাগের শুনানিতে কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ দেন আদালত।

২২ জুলাই সোমবার কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। কারফিউ জারি থাকায় সহিংসতা কমলেও উৎকণ্ঠা ও টানাপোড়েন চলতেই থাকে।
আন্দোলনের জের ধরে ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় গ্রেফতার ও মামলার সংখ্যা বাড়ে।

২৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নেয় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরের কয়েকদিনে আরও কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করার একটি ভিডিও বার্তা দেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে অন্য সমন্বয়কেরা অভিযোগ করেন, জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে এ বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে।

আগস্টে বাংলাদেশ

০২ আগস্ট শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েক হাজার মানুষ। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসি এলাকা ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশ করেন তারা।

০৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় বিশাল সমাবেশ হয়, যেখানে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও সমাবেশ হয়।

ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঘোষণা করা হয় এক দফা। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এ সরকারের কোনোভাবেই আর এক মিনিট ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।  

আন্দোলনকারীদের পক্ষে ০৪ আগস্ট থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি পালনের ডাক দেওয়া হয়। অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে চার তারিখ থেকেই তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।

এদিন সারা দেশে সহিংসতায় পুলিশসহ অন্তত ৮৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আহত হন অনেক মানুষ।

প্রথমে ০৬ আগস্ট ঘোষণা করা হলেও পরে একদিন এগিয়ে ০৫ আগস্ট সরকার পতনের দাবিতে লং মার্চ টু ঢাকা’র ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

শেখ হাসিনার পতন

০৪ ও ০৫ আগস্ট সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জমায়েত ও পাহারার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, সরকারবিরোধীদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে টিকতে পারেনি তারা।

সকালের দিকে ঢাকার প্রবেশপথগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেলা বাড়ার পর থেকে উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে আন্দোলনকারীরা শহরের ভেতরে ঢুকতে শুরু করে।

দুপুর নাগাদ ঢাকার পথঘাট আক্ষরিক অর্থেই আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। লাখ লাখ মানুষকে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়।  

এক পর্যায়ে খবর আসে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। সঙ্গে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা।

সরকারবিহীন তিন দিন

পাঁচ তারিখ থেকে তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ব্যাপক অবনতি দেখা দেয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ও নেতাকর্মীদের অনেকের বাড়িঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।  

থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলা হয়। বেশকিছু থানা ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, অস্ত্র লুট ও কয়েদি পালানোর মতো ঘটনাও ঘটে। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনার খবরও আসে। অরাজকতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যদের মাঠে নামানো হয়। অনেক এলাকা সাধারণ মানুষ বা স্বেচ্ছাসেবীরা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নেন।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠন

নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ০৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। সরকার গঠনের পরপরই বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও অভিনন্দন পান মুহাম্মদ ইউনূস।

অন্যদিকে সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যায়।

এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়েন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্থসহ নানা চাপের মুখে কর্মকর্তারা পদত্যাগে বাধ্য হন।

দেশজুড়ে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। সচিব থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ বিভিন্ন পদে পরিবর্তন আসে।

দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকা বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকে মুক্তি পেয়েছেন এরইমধ্যে।

সংখ্যালঘু ইস্যু

সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ ও অধিকার প্রশ্নে কয়েকটি সংগঠন সোচ্চার হয়। আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামে তারা সমাবেশ করে।

সনাতনী জাগরণ মঞ্চ নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে পরবর্তীতে সময়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

পুলিশের সঙ্গে তার অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবী নিহত হন।

আগে থেকেই ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তবে বিবিসি'র অনুসন্ধানে দেখা যায় এসময় ভুয়া খবর ও ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের একটা বড় অবনতি হয়।

শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভুয়া খবর, আগস্টের শেষ দিকে বন্যা পরিস্থিতি ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি দেখা দেয়।

ঘটনা আরও ঘনীভূত হয় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও তার জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যার ঘটনা ঘিরে।

চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন অভিমুখে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে।  

এর ধারাবাহিকতায় ২৮ নভেম্বর কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয়। ০২ ডিসেম্বর হঠাৎই আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটে।  

এ ঘটনায় বাংলাদেশ ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ জানায়। অন্যদিকে ভারত দুঃখ প্রকাশ করে। পরে এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক ও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ডিসেম্বরের শেষে ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরাতে একটি কূটনৈতিক পত্র বা ‘নোট ভার্বাল’ পাঠায় বাংলাদেশ।

সংস্কার ও বিচার

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। একে একে বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টিতে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অর্থনীতিকে কোন অবস্থায় রেখে গেছে তা জানতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

এর মধ্যে আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল হয়ে যায়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে আইনি বাধা দূর হয়ে যায়।

কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটা হত্যা, নির্যাতনের বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে সরকার।

পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পরিবার এবং তার মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অজস্র অভিযোগ ও সংবাদ সামনে আসতে থাকে। মামলা হয়, তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

নাজুক ব্যাংক খাত: তারল্য সংকট

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। সেই চর্চায় বছরের শুরুর দিকে নতুন রসদ যোগায় ‘নয়টি ব্যাংক রেড জোনে অবস্থান করছে’, এই মর্মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদন।

এর আগে থেকেই ব্যাংকিং খাতকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সব দুর্বল বা খারাপ ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পালাবদলে একীভূতকরণ কার্যকর হয়নি।

বছরের মাঝামাঝি থেকে বেসরকারি খাতের নয়টি ব্যাংকে তার‍ল্য সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতে পারছিল না তারা। নভেম্বরে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে দেওয়ার কথা জানান নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪

আরএইচ
 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।