ঢাকা, সোমবার, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

পেরেশানিতে পুলিশ

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
পেরেশানিতে পুলিশ

ঢাকা: ২০২৪ অভ্যুত্থানের পর প্রায় ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।

খুন, ছিনতাই, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেই চলেছে।  

পুলিশ ঠিকমতো ডিউটি পালন করছে না বলে অভিযোগ জনগণের। প্রশ্ন উঠছে পুলিশের নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়েও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিকভাবে ইমেজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুলিশ সদস্যরা এখনো বিভিন্ন জায়গায় নিগৃহীত হচ্ছেন। সামাজিকভাবে পুলিশ এখন অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এমনকি কে কার ক্যাশিয়ার এভাবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে অনেককে।  

সেই সঙ্গে আগের মতো ঘুষবাণিজ্য না থাকায় জীবনযাপনও করতে পারছেন না আগের স্টাইলে। অবৈধভাবে যারা সম্পদের মালিক হয়েছেন, অনেকের সেসব সম্পদও চলে যাচ্ছে ভোগদখলের বাইরে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত নানা টানাপোড়েনের মধ্যে সময় কাটছে পুলিশের। এত প্রতিকূল অবস্থায় পেরেশানিতে রয়েছে পুলিশ বাহিনী। তবে ট্রমা কাটিয়ে জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি।

জানা যায়, পুলিশ বাহিনী থেকে লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলোর সব এখনো উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের ধারণা, দুর্বৃত্তদের কাছেই রয়েছে এসব খোয়া যাওয়া অস্ত্র। এসব অস্ত্র দিয়ে দুর্বৃত্তরা অংশ নিচ্ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে । আবার অপরাধ দমনসংশ্লিষ্ট নানা অভিযানে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। এখনো ভুগছেন অজানা আতঙ্কে।  

আরও জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে হতাহতসহ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে পুলিশ। ৪৪ পুলিশ সদস্য নিহতসহ অসংখ্য সদস্য আহত হন। থানা ও পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুট হয় অস্ত্র-গুলি। ভয়ে গা ঢাকা দেন অনেক পুলিশ সদস্য। দেশ ছাড়েন কেউ কেউ। এখনো ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য কাজেই যোগ দেননি। অনেকে যোগ দিয়েও নিয়মিত অফিস করছেন না। অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে আবার গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। পুলিশের প্রতি মানুষের অবহেলা প্রতিনিয়ত ফুটে উঠছে। পুলিশের কথা কেউ শুনতে চাচ্ছে না। সামাজিকভাবেও পুলিশের ইমেজ নষ্ট হয়ে গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি তলানির দিকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অপহরণ, লুট, চাঁদাবাজির ঘটনা জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম
গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে চাপাতি হাতে, মাস্ক পরে এক দল সন্ত্রাসী এহতেশামুল হক নামে এক ব্যবসায়ীকে এলোপাতাড়ি কোপায়।  

আহত এহতেশামুল হক মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।  

মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির ব্যবসায়ী নেতাদের অভিযোগ, চাঁদা না দেওয়ায় ‘ইমন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা’ এহতেশামুল হককে চাপাতি দিয়ে কোপায়। মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কয়েক দিন ধরে ইমন গ্রুপের লোকজন সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করে আসছে। চাঁদা না দিলে হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চাঁদা না দেওয়ায় একজন ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখমের ঘটনার পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

সাবেক ওসির পলায়ন
বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরা পূর্ব থানা হেফাজত থেকে পালিয়ে যান সাবেক ওসি শাহ আলম। তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের মামলায় আগের দিন কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে এ ঘটনায় বর্তমান ওসি মো. মহিবুল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়।  

পুলিশের আত্মহত্যা
গত ৯ জানুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল আমিন তার নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ বলছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিষন্নতায় ভুগছিলেন।

মিরপুরে ব্যবসায়ীকে অপহরণ
গত বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে রাসেল খান নামের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়। পরদিন পুলিশ তাকে শেওড়াপাড়ার একটি বাসা থেকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।  

ভুক্তভোগী রাসেল খান বলেন, অপহরণকারীরা তার কাছে ১০ লাখ চাঁদা দাবি করে। ওই টাকার জন্য তাকে দিয়ে মা-বাবা ও স্ত্রীকে ফোন করানো হয়। বিষয়টি রাসেল তার এক বন্ধুকেও জানান। ওই বন্ধু ঘটনাটি মিরপুর মডেল থানায় জানালে পুলিশ শুক্রবার রাত ৯টার পর শেওড়াপাড়ার ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এদিকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে চারটার দিকে কলাবাগান এলাকায় পিকআপসহ তিনটি গরু ডাকাতি করে একদল দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রিয়াজ গোলদার নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার শাহ আলী থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৮ মিনিটে ১৫৯ ভরি সোনা চুরি
গত শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) দুপুর ১টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি মডেল থানাধীন বিজিবি সীমান্ত সম্ভার শপিং কমপ্লেক্সের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ‘ক্রাউন ডায়মন্ড অ্যান্ড জুয়েলার্স’ শো-রুমে চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই শো-রুমের মালিক কাজী আকাশ ধানমন্ডি মডেল থানায় একটি মামলা করেন। তিনি মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন অজ্ঞাতনামা চোরেরা শো-রুমের তালা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে ১৫৯ ভরি বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণালংকার চুরি করে নিয়ে যায়। যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) থেকে শনিবার (১১ জানুয়ারি) পর্যন্ত ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে কক্সবাজার ও কুমিল্লা থেকে তিন চোরকে গ্রেপ্তার করে ডিবি লালবাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে চুরি হওয়া ৫০ ভরি আট আনা স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের এই নিস্ক্রিয়তা বা হতাশামূলক পারফরম্যান্সের বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর এবার জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থান। তৎকালীন পতিত সরকার পুলিশকে তাদের নিজেদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করেছে। বড় একটা পরিবর্তন আসায় পুলিশের মাঝে ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে। তবে বর্তমান সরকার নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশের ভেঙে পড়া ইমেজ ফিরিয়ে আনার। বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছেও। তবে দরকার একটি গণতান্ত্রিক সরকার। ’ 

সাবেক আইজিপি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত হবে ঘন ঘন বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শনে যাওয়া। স্থানীয় সম্মানিত এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে বৈঠক করে পুলিশ সদস্যদের আশ্বস্ত করা। এতে তৃণমূলে এবং বিভিন্ন ইউনিটে কাজ করা পুলিশ সদস্যরা নানা বিষয়ে অ্যাসিউর এবং রিঅ্যাসিউর হবেন।  

পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের মাঝে মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য মোটিভেশনাল উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সুশীল সমাজকে। সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এবং দেশের সব থানায় আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে। ’

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তারা নৈতিক সংকটে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো পূর্ণ সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ছাড়া নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ’

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে। বিগত সরকারের সময় পুলিশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্যাডার তৈরি হয়েছিল। তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করত না। যখন যা খুশি তা-ই করত। ঘুষবাণিজ্য থেকে শুরু করে অপহরণ, গুম ও দখল বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। বেপরোয়া জীবনযাপন করত। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের কারণে হঠাৎ ছন্দপতন হয় পুলিশের। কোনোভাবেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। জনগণের আস্থার জায়গায় ফিরতে পারছে না। মূলত পুলিশকে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে অপরাধ, সেখানেই তাদের উপস্থিতির জানান দিতে হবে। এতে মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হবে, পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
এমএমআই/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।