ঢাকা, রবিবার, ১ চৈত্র ১৪৩১, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১৫ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

চা বাগানে তীব্র খরা মোকাবিলায় চলছে ‘ইরিগেশন’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
চা বাগানে তীব্র খরা মোকাবিলায় চলছে ‘ইরিগেশন’ চা বাগানে পানি ছিটানো হচ্ছে

মৌলভীবাজার: চা বাগানে রোদের তীব্রতা বয়ে আনে চরম দুর্গতি! এ দুর্গতি মানেই চা গাছ পর্যাপ্ত পানির অভাবে শুকিয়ে যায়। কখনো কখনো পুরোপুরি মরে যায়।

নয়তো চা গাছের পাতায় দেখা দেয় নানান রোগবালাই। তীব্র তাপদাহে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে তখন আর পরিচর্যা বা কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো লাভ হয় না।

এ সব অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতেই যান্ত্রিক উপায়ে ছিটানো হয় পানি। এই পদ্ধতির নামই ইরিগেশন। বাংলায় বলা হয় সেচ। প্রকৃতিতে খরার তীব্রতা থেকে চা গাছগুলোকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এই পানির ব্যবস্থা।

শুধু আধুনিক ইরিগেশনই নয়, প্রাচীন পদ্ধতিতেও অর্থাৎ নারী চা শ্রমিকরা ছড়া থেকে কলসে করে পানি নিয়ে এসে চা গাছের গোড়ায় গোড়ায় পানি ঢেলে দেয়।
চা বাগানে এখন প্রচণ্ড মাত্রায় খরা চলছে। প্রকৃতির তাপদাহে চা গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে এখন থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাগানগুলো। চা বাগানের প্রতিটি সেকশনে (সুনির্দিষ্ট চা গাছ বেষ্টিত এলাকা) চালু করা হয়েছে ‘ইরিগেশন’। এই সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে নবীন চা গাছ এবং প্রাপ্তবয়স্ক চা গাছ দুটো প্রজাতির চা গাছগুলোকে আগেভাগেই পানি দিয়ে তরতাজা করে রাখা।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, সিলেটের তথ্যমতে বৃহত্তর সিলেট বিভাগে এখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চলছে ৩২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচণ্ড খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে চা গাছ।

সরেজমিনে দেখা গেল, যে মেশিন দিয়ে পানি দেওয়া হচ্ছে সেই মেশিনটি বিশালাকৃতির। অনেক দূর থেকে তার যান্ত্রিক ধ্বনি চারপাশে তীব্র গর্জনের মতো শোনায়। কালো কালো বিশাল বিশাল পাইপ চা শ্রমিকরা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে টিলার ওপর প্রতিস্থাপন করছে। কিছুক্ষণ পরই মেশিনম্যান এসে ইরিগেশন মেশিন চালু করলেন। পাইপের শেষ মাথায় যেটা থেকে পানি ঝর্ণার মতো ছিটকে নির্গত হয়, সেটাকে নজেল (যার মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়) বলে। সেই নজেল সেটা ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ পানি একদিকে না ছিটিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে ছিটায়। প্রায় ৪০-৫০ ফুট দৈর্ঘ্য পর্যন্ত একটি নজেল পিচকারির মতো চা গাছগুলোতে পানি ছিটাতে থাকে। কিছু সময় পর সেখানকার কর্মরত শ্রমিকরা এসে নজেলগুলো অন্য জায়গায় সরিয়ে দেয়। তখন নতুন করে আবার অন্য জায়গায় চা গাছগুলোতে এই নজেলের সাহায্যে পানি দেওয়া শুরু হয়।   

সেখানে কর্মরত কাজল হাজরা বলেন, ডিজেলচালিত এই পাম্প মেশিনটি ৭৫ হর্সপাওয়াসম্পন্ন। অনেক শক্তিশালী এটি। একসঙ্গে দুই টিলায় প্রায় আধা কিলোমিটার দূরত্বের জায়গাজুড়ে পানি ছিটিয়ে থাকে। প্রথম ধাপে ৪ ঘণ্টা চলানো হয়। তারপর এক ঘণ্টা বিশ্রাম দিয়ে আবার পরবর্তী ধাপে আবার ৪ ঘণ্টা চালানো। ৪ ঘণ্টায় ২০ লিটার ডিজেল লাগে।

এই মেশিনের মোট ১২টি নজেল রয়েছে। প্রথম পর্যায়ের ৪ ঘণ্টায় ৬টি নজল চালু করা হয়। পরে দ্বিতীয় ধাপে অন্য টিলায় যখন ইরিগেশন দেওয়া হয় তখন আরও ৬টি নজেল চালু করা হয়ে থাকে।

মিঠুন হাজরা বলেন, প্রতিটি টিলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ৪ ঘণ্টা পানি দেওয়া হয়। মেশিনে পানির গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মিটার আছে। মিটার কমিয়ে দিলে পানির গতি কম হবে। তখন কম পানি লাগবে। এই পানি মাটির প্রায় আধা ফুট ভেতরে ঢুকে যায়। আবার কয়েকটি সেকশনে ঘুরে আসতে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ লেগে যায়। আর যদি বৃষ্টি চলে আসে তখন ইরিগেশন মেশিন আর চালানো লাগে না।   

বাংলাদেশীয় চা সংসদের (বিটিএ) মালিকপক্ষের প্রতিনিধি এবং সিনিয়র টি-প্লান্টার ইবাদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এখন খরা মৌসুম চলছে। কোনো প্রকার বৃষ্টিপাত নেই। আগামী মাসগুলোতে তীব্র খরা আসবে। এই খরা চা গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই খরা থেকে চা গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা প্রতি বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটা মাসে ইরিগেশন বা সেচ এর ব্যবস্থা করে থাকি।  

ইরিগেশনের নিয়মটা হলো বৃষ্টিমাপক যন্ত্র ‘রেইনগেজ মিটার’ (বৃষ্টি পরিমাপক যন্ত্র) বসাতে হয়। যখন ৩ ইঞ্চি পরিমাণ পানি পড়ে তখন ইরিগেশনের পাইপগুলো এক সেকশন জায়গা থেকে অন্য সেকশনে সরাতে হয়। এটা হলো নিয়ম। তবে চা বাগানে বৃষ্টির কাজটা ইরিগেশনে চলে না। এর কারণটা হলো- এখানে এখন টেম্পারেচার (তাপমাত্রা) শুষ্ক। ইরিগেশন দেওয়া সঙ্গে সঙ্গেই পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, ইরিগেশন দেওয়ার আসল নিয়ম হলো রাতের বেলা। তখন পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায় না। তবে রাতের বেলা রিস্ক (ঝুঁকি) আছে। মেশিনের তেল চুরি হয়, পাইপ চুরি হয়, অন্যান্য মেশিনারি জিনিসপত্র চুরি হয়। দিনের বেলা ইরিগেশনে করলে পানি ৫০ ভাগ লস (ক্ষতি) হয়। চা বাগানের ইয়াং টি (নবীন চা) এবং ম্যাচিউর টি (প্রাপ্তবয়স্ক চা) দুটোর সেকশনেই ইরিগেশন দিয়ে থাকি।

ইরিগেশনের পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এই ইরিগেশনের নাম  ‘স্প্রিংকলার ইরিগেশন’। মাঝে পানিগুলো ঝর্নার মতো চা গাছের পাতায় পাতায় পড়বে। আরেকটা ইরিগেশন হলো ‘ফ্লাড ইরিগেশন’। এটা সমতল ভূমির জন্য। পাইপের মুখ খুলে ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে পুরো সেকশনে ৩ ইঞ্চি পানি হয়ে যায়।

আরেকটি ইরিগেশন হলো ‘ড্রিপ ইরিগেশন’। আমরা যখন টিলাতে ইরিগেশন দেই তখন কিন্তু অনেক পানি টিলা বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে আসে। আর ড্রিপ ইরিগেশন হলো জায়গায় জায়গায় ড্রামের মধ্যে পানি দিয়ে রাখে ওখান থেকে সলিতা (পাটের দড়ি) মাঝে মাঝে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রেখে দেয়। এই পদ্ধতিতে পানিটা অপচয় হয় না। ধীরে ধীরে পানিগুলো চা গাছের একদম গোড়ায় প্রবেশ করে।

ইরিগেশন মেশিনের পাইপ চা বাগানের লেক বা হ্রদে প্রবেশ করানো হয়। সেখান থেকে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের সিলেটের চা বাগানগুলোতে স্প্রিংলার ইরিগেশন চালু আছে বলে জানান চা সংশ্লিষ্ট এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
বিবিবি/আরএ         

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।