ঢাকা: রাজনৈতিক সরকারের সময়ে গতানুগতিক ধারার বাজেট না দিয়ে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে শিক্ষাখাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আলাদা বাজেট ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান।
সোমবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় শিক্ষা বাজেট: আমাদের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক প্রাক বাজেট সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে আগামী বাজেটে শিক্ষা বিষয়ে বিস্তারিত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন এডুকেশন ওয়াচের ফোকাল পয়েন্ট মোস্তাফিজুর রহমান। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর সঞ্চালনায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ ও সিপিডির রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আলোচনায় অংশ নেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেন এডুকেশন ওয়াচের ফোকাল পয়েন্ট মোস্তাফিজুর রহমান। সেখানে গত দশ বছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন এবং আগামী বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে ২১ দফা প্রস্তাবনা সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশগুলোর মধ্যে স্বল্পমেয়াদে ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও মধ্যমেয়াদি ভিত্তিতে চাকরির বাজার বিবেচনায় গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা; আগামী অর্থবছরে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ করা এবং ধীরে ধীরে ২০৩০ সালের মধ্যে তা ২০ শতাংশে উন্নীত করা; শিক্ষক প্রশিক্ষণ বাড়ানো, বেতনভাতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলা; শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গড়ে তোলা; অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা; এক তৃতীয়াংশের বদলে সব শিক্ষার্থীদের জন্য মিড-ডে মিল চালু করা; আমদানিকৃত বিদেশি বইয়ের ওপর ট্যাক্স মুক্ত করা; নারী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া এবং সামাজিক খাত হিসেবে শিক্ষায় বরাদ্দ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা অন্যতম।
প্রতিবেদনে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত শিক্ষায় বাজেট টাকার অংকে বাড়ছে। কিন্তু জিডিপির হারে প্রতিবার বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে জিডিপির ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বরাদ্দ ছিল সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে মোট বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির হারে তা ১ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি বাজেটের অনুপাতও কমেছে। তার বিপরীতে প্রতিবছর শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অবকাঠামো বাড়ছে। কিন্তু বরাদ্দ কমার কারণে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে না।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হয়। শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা ধর্ম খাতের বরাদ্দ যুক্ত করে দেওয়া হয়। অন্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা যায় অপারেটিং বাজেটের তুলনায় ডেভেলপমেন্ট বাজেট অনেক বেশি থাকে। কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্দের অধিকাংশ খরচ হয় শিক্ষকদের বেতনভাতা, ভবন তৈরিতে। কিন্তু শিক্ষকের গুণগতমান বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় বাংলাদেশের বাজেট সবচেয়ে কম ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার বরাদ্দ অনেক বেশি। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয় ভুটান ৮ দশমিক ০১ শতাংশ। বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এছাড়া জিডিপির ৬ শতাংশের জায়গায় শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই চরম বৈষম্য রয়েছে। দেশে যে তিন ধারার (বাংলা, ইংরেজি ও মাদরাসা) শিক্ষা রয়েছে প্রতিটির মধ্যেই বৈষম্য রয়েছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেটাতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভালো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যতটুকু গুণগত শিক্ষা আছে তার সবটাই সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষার সুবিধা পাচ্ছে না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে আমরা আশা করেছিলাম শিক্ষা নিয়ে হয়তো ব্যাপক কাজ হবে। কিন্তু আমরা তেমন কোনো আলোচনা দেখছি না। এমনকি শিক্ষা নিয়ে একটি কমিশনও করা হয়নি। আমাকে প্রধান করে প্রাথমিকে একটি পরামর্শক কমিটি করা হয়েছিল, আমরা একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছি। কিন্তু সেই অনুসারে কতটুকু কাজ সে বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছি না। আর প্রতি বছর একটা গতানুগতিক ধারায় শিক্ষা বাজেট করা হয়। যেটার মধ্যে শুধুই কিছু বরাদ্দ বাড়িয়ে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাজেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় না। খাতভিত্তিক কোথায় গুরুত্ব দিতে হবে সে নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। ফলে বাজেটে কিছু অর্থ বাড়লেও তা দিয়ে কাজের কিছুই করা যায় না।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমরা দেখেছি শিক্ষাকে সবসময় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যুক্ত করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার বরাদ্দের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। একক খাত হিসেবে শিক্ষাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। জ্বালানিকে আলাদা খাতকে হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু শিক্ষাকে করা হয় না। জ্বালানি অবশ্যই দরকার কিন্তু শিক্ষাকে তার চেয়ে বেশি দরকার। শিক্ষায় সমাজের ভিত গড়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। সব ধারার শিক্ষাকে করা না গেলেও অন্তত মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবৈতনিক করা দরকার। পাশাপাশি উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। ১৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করতে হবে। কারণ শিক্ষার খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের এই খরচ বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।
সিপিডির রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষমুক্ত থেকে বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব। এটি আমাদের প্রত্যাশা। রাজনৈতিক সরকারের অভিলাসের কারণে এতদিন শিক্ষাখাত বঞ্চিত হয়েছে। তবে এবারের বাজেটে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে চায় না। এবার যেহেতু রাজনৈতিক কারণে অবকাঠামো খাতে প্রচুর বরাদ্দ দেওয়ার প্রয়োজন নেই ফলে এভার যেন সামাজিক খাত হিসেবে শিক্ষাকে বাস্তবিক অর্থে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় সেই আশা আমরা রাখছি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শিক্ষাখাতের মধ্যে অন্য আরও কয়েকটি খাতজুড়ে দিয়ে বরাদ্দ বেশি দেখানো হয়। অথচ এসব খাতের সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক থাকে না। কয়েকটি খাত একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের খাত বলা হয়। কিন্তু ভেতরে খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যায় একক খাত হিসেবে শিক্ষায় বরাদ্দ খুবই কম। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি অন্তত তারা যেন এভাবে শিক্ষাকে বড় আকারে না দেখান। শিক্ষাখাতের বাজেট যাতে আলাদা করে ঘোষণা করা হয়।
খন্দকার মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা প্রতিবছর শিক্ষা বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলছি। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত বাজেটই ব্যবহার করতে পারে না। যেটুকু খরচ করে সেটুকু মানসম্মত হয় না। সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে ২০২২ সালে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ৭৮ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে। এটাই একটা বড় সমস্যা। একদিকে বাজেট কম আবার যেটুকু দেওয়া হচ্ছে সেটাও খরচ করতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বাজেট খরচ করতে না পারার হার বেশি। এটির মানে হচ্ছে এগুলোর ভেতরে চরিত্রগত কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৫
এমআইএইচ/আরবি